টমেটো চাষ পদ্ধতি

সাধারণভাবে টমেটো চাষ-এর থেকেও বীজ উৎপাদনের জন্য টমেটো চাষ করার ক্ষেত্রে বীজ শোধন থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত অনেক বেশী সতর্ক এবং যত্নবান হওয়া দরকার। আগের বছর টমেটো বা একই গোত্রের অন্য সবজি চাষ হয়েছে—এইরকম জমি বীজ তৈরীর জন্য নির্বাচন করা উচিৎ নয়।

Tormuj chas bangla | তরমুজ ও খরমুজ

টমেটোর মূল জমি তৈরী

চারা লাগানোর ২০-২৫ দিন আগে বিঘা প্রতি ৩০-৩৫ কুইন্টাল জৈব সার প্রয়োগ করে জমির মাটিতে অনেকগুলি চাষ দিয়ে রোদ খাওয়াতে হবে। চারা লাগানোর ৪-৫ দিন আগে মূল সার হিসাবে ৭ কেজি নাইট্রোজেন, ৭ কেজি ফসফেট এবং ৩.৫ কেজি পটাশ প্রয়োগ করতে হবে। কার্তিকের দ্বিতীয় সপ্তাহে বীজ বুনে অগ্রহায়নের মাঝামাঝি মূল জমিতে চারা রোপণ করলে সেই ফসল থেকে ভালো মানের বীজ পাওয়া যাবে।

টমেটোর বীজ সংগ্রহ এবং বীজ শোধন

সব সময় বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে, বীজ উৎপাদনের ফসলের জন্য পরিবর্ধক (Breeder seed) বীজ বা আধারীয় বীজ (Foundation seed) ব্যবহার করতে হবে। একান্ত না পাওয়া গেলে সংশিত বীজ নেওয়া যেতে পারে। বীজ বোনার আগে অবশ্যই বীজ শোধন করা দরকার।

(১) শুকনো শোধন—প্রতি কেজি বীজের জন্য ২-৩ গ্রাম থাইরাম, ক্যাপ্টান বা

কার্বেণ্ডাজিম মিশিয়ে মুখ বন্ধ পাত্রে ৮-১০ মিনিট ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। (২) ভিজিয়ে শোধন—কার্বেণ্ডাজিম ৫০ শতাংশ ২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে ঐ ওষুধ গোলা জলে বীজ ২৫-৩৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে।

বীজতলায় বীজ বপণ ও পরিচর্যা

বীজতলায় লাইনে বা সারিতে বীজ বপণ করতে হবে ২”x৩” বা ” x ৪” দূরত্বে। যেহেতু বীজতলা খুব অল্প জায়গায় হয় তাই পরবর্তীতে ভাইরাস ঘটিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে বীজতলায় মশারী টাঙ্গিয়ে রাখার দরকার। বীজ বোনার পর চারা বের হওয়ার আগে পর্যন্ত শোধন করে নেওয়া খড় অথবা খবরের কাগজ চাপা দিয়ে রাখতে পারলে ভালো হয়। ঝারির সাহায্যে মাঝে মাঝে পরিমিত জলসেচ দিতে হবে।

বীজতলা তৈরী এবং শোধন

১ বিঘা মূল জমি চাষের জন্য ১ মিটার চওড়া এবং ৬ মিটার লম্বা একটি বীজতলা দরকার হয়। বীজতলা শোধনের জন্য বীজ বোনার ৩ সপ্তাহ আগে প্রয়োজনীয় জৈব সার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর প্রতি বর্গমিটার বীজ তলার জন্য ১০ লিটার জলে ৬০ মিলি ফর্মালিন মিশিয়ে বীজতলা ভিজিয়ে পলিথিন দিয়ে ৭-১০ দিন ঢেকে রাখতে হবে। ১০-১২ দিন পরে পলিথিন চাদর সরিয়ে দিয়ে মাটি ভালো করে কুপিয়ে গ্যাস বের করে দিতে হবে। এর ৭-১০ দিন পরে ঐ বীজতলায় বীজ বোনা যাবে।

এছাড়া শুধু মোটা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে বীজতলার মাটি ১০-১২ দিন ঢেকে রাখলে পলিথিনের ভিতরে যে প্রচন্ড তাপের সৃষ্টি হয় তাতেও বীজতলার মাটি শোধন করা হয়।

বীজের পরিমাণ–৩-৩.৫ গ্রাম / কাঠা।

বীজতলা থেকে চারা তোলা ও মূল জমিতে রোপণ

সুস্থ সবল ১২-১৫ সেমি লম্বা অথবা ৪ থেকে ৭ সপ্তাহ বয়সের ৫ থেকে ৭ টি পাতা বিশিষ্ট চারা বীজতলা থেকে তুলতে হবে। চারা তোলার ৩-৪ দিন আগে বীজতলায় সেচ বন্ধ করতে হবে। এই সময়ে ক্যাপটান ৫০ শতাংশ ১ গ্রাম এবং ডাই মিথাইল ৩০ শতাংশ ১ মিলি/লি একসাথে গুলে প্রয়োগ করে বীজ তলায় ২” পর্যন্ত ভিজিয়ে দিতে হবে। বিকালের দিকে চারা তুলতে হবে এবং চারা তোলার ৫ ৬ ঘন্টা আগে একটা হাল্কা সেচ দিলে চারা তুলতে সুবিধা হয় এবং শিকড় অনেক কম ছেঁড়ে। এরপর মূল জমিতে ৬০ সেমি ×৬০ সেমি দূরত্বে সারিতে চারা রোপণ করতে হবে এবং চারা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে সেচ দিতে হবে।

অন্তরণ দূরত্ব (Isolation distance)

টমেটোর ক্ষেত্রে স্বপরাগ সংযোগ ঘটে। তবুও নির্দিষ্ট মানের উন্নত বীজ পাওয়ার জন্য টমেটোর একই জাত বা আলাদা জাতের ক্ষেত থেকে বীজ উৎপাদনের ক্ষেতের মধ্যে সংশিত বীজের ক্ষেত্রে ২৫ মিটার এবং আধারীয় বীজের ক্ষেত্রে ৫০ মিটার অন্তরণ দূরত্ব রাখতে হবে।

ক্ষেত পরিদর্শন এবং অবাঞ্ছিত গাছের উচ্ছেদ

নির্দিষ্ট মানের বীজ পেতে টমেটো ক্ষেত আগাছা মুক্ত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মোট তিন বার ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং এই সময়ে অবাঞ্ছিত গাছ মূলতঃ যে সব গাছের পাতায় বা ফলে জলদি ধ্বসা, পাতায় দাগ, মোজাইক, ফল পচা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যাবে, সেগুলি তুলে ফেলতে হবে। অন্যরকম দেখতে এমন গাছ, ফুল বা ফল ধরা অবস্থায় গাছ তুলে ফেলতে হবে।

প্রথম বৃদ্ধি দশায়

দ্বিতীয় – ফুল-ফল অবস্থায়

তৃতীয় – পরিপক্ক অবস্থায়

চাপান সার প্রয়োগ এবং পরিচর্যা

চারা রোয়ার ৩ সপ্তাহ এবং ৬ সপ্তাহ পরে গোড়ায় মাটি ধরানো এবং নিড়ানী দেওয়ার সময় বিঘা প্রতি ৩.৫ কেজি নাইট্রোজেন এবং ১.৫ কেজি পটাশ প্রতিবারে চাপান হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে, জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। প্রয়োজনমত সেচ দিতে হবে। রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রোগাক্রান্ত বা পোকা আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে এবং ক্ষেত থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে হবে।

ভালো মানের বীজ উৎপাদনের জন্য অণুখাদ্যের প্রয়োগ

অণুখাদ্যের অভাব জনিত জমিতে ভালোমানের বীজ উৎপাদন করতে অবশ্যই প্রয়োজন মত অণুখাদ্য প্রয়োগ করা দরকার। বিভিন্ন অণুখাদ্যের অভাব জনিত লক্ষণ ও তার প্রতিকার –

(ক) বোরণ—এর অভাবে প্রথমে শিকড়ের বৃদ্ধি কমে যায়। পুরানো পাতা মোটা হয়ে যায় এবং উপরের দিকে মুড়ে আসে। কচি অংশ শুকিয়ে যায়। অতিরিক্ত অভাবে ফল ফেটে যায়। ফুলের কুঁড়ি ও ছোট ফলের বোঁটা বা বৃত্ত হলুদ হয়ে শুকিয়ে ঝরে পড়ে। মূল জমিতে চারা রোয়ার ৩ সপ্তাহ এবং ৬ সপ্তাহের মাথায় দু’বার ২০ শতাংশ বোরণ ১ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।

(খ) জিংক—–প্রথম অবস্থায় চার রোয়ার ৩ সপ্তাহ এবং ৬ সপ্তাহের মাথায় জিংক ০.৫-১ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে গাছে স্প্রে করতে হবে। (গ) মলিবডেনাম—গাছের মাথার কচি পাতাগুলি কুঁচকিয়ে এক জায়গায় থোকা হয়ে দু’বার চিলেটেড

যায়। গাছের বৃদ্ধি কম হয়। কখনো কখনো কোঁচকানো পাতার ধার ও শিরা বেগুনী রঙের হয়ে যায়। এই অবস্থাকে কুটে রোগের আক্রমণ বলে ভুল হয়। প্রতিকার হিসাবে বিঘা প্রতি ১.২৫ কেজি অ্যামোনিয়াম মলিবডেট মূল সারের সাথে প্রয়োগ অথবা চারা লাগানোর ২৫-৩০ দিন পরে ০.৫ গ্রাম/লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।

বীজের জন্য ফল সংগ্রহ

ভালো মানের বীজ পেতে বড় সাইজের টমেটো সংগ্রহ করতে হবে। এগুলি লাল রঙের, বেশী পাকা হওয়া উচিত। টমেটো পেকে সামান্য ফেটে গেলে সেই ফলও বীজের জন্য সংগ্রহ করা যাবে। তবে প্রথম দিকের সবুজ টমেটো বা একদম শেষ দিকের ছোট টমেটো নেওয়া যাবে না।

ফল থেকে বীজ নিষ্কাশন

টমেটো ফাটিয়ে ৩-৪ দিনের মত পচিয়ে নেওয়ার পর জল দিয়ে ধুয়ে বীজ গুলিকে আলাদা করে নিতে হবে। বীজ গুলিকে চালনীর মধ্যে ফেলে ভালো করে ধোয়া দরকার যাতে যেন বীজের গায়ে কোন কিছু লেগে না থাকে। অ্যাসিড বা ক্ষার দিয়েও বীজ নিষ্কাশন করা যায়। যন্ত্রের সাহায্যে বীজ নিষ্কাশন করতে কম সময় লাগে এবং ভালো মানের বীজ পাওয়া যায়।

বীজ সংরক্ষণ

বীজ জল দিয়ে ধুয়ে নেওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুকানো দরকার। বীজ পালা করে রেখে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ৪০° সেলসিয়াস এর বেশী তাপামাত্রা থাকলে আংশিক ছায়ায় শুকাতে হবে। কৃত্রিম ভাবে যন্ত্রের মাধ্যমে শুকালে প্রথমে কম তাপমাত্রা এবং পরে ধীরে ধীরে তাপমাত্রা ৪০° সে. পর্যন্ত নিয়ে শুকাতে হবে। বীজের আর্দ্রতা হবে ৬-৫ শতাংশ এর মধ্যে।

কাপড়ের ব্যাগে অথবা কোন ভাল মুখ বন্ধ পাত্রে শোধন করা শুকনো বীজ রেখে সেটি ঠাণ্ডা-শুষ্ক জায়গায় রাখলে ২-৩ বছর পর্যন্ত এই বীজ ব্যবহার করা যাবে। বছরে ২-৩ বার পুণরায় রোদে শুকিয়ে রাখতে পারলে ভালো হয়।

বীজের ফলন—১৫ কেজি প্রতি বিঘা