পশ্চিমবঙ্গে কৃষির কিছু বৈশিষ্ট ও জৈব কৃষি প্রসারের অনুকূল অবস্থা

পশ্চিমবঙ্গে কৃষির কিছু বৈশিষ্ট ও জৈব কৃষি প্রসারের অনুকূল অবস্থা

১) রাজ্যের কৃষককুল নতুন প্রযুক্তি বা সম্প্রসারণের প্রতি সর্বদা আগ্রহী ও কার্যকরী করতে সচেষ্ট এবং কৃষি শ্রমিকের লভ্যতাও ভালো।

২) রাজ্যে খাদ্যশস্য গুলির মধ্যে ডালশস্য এবং ফল ও সবজি চাষ এবং উৎপাদশীলতা বৃদ্ধির ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।

৩) দেশের মোট ৪৫টি রপ্তানী এলাকার মধ্যে ৫টি এই রাজ্যে অবস্থিত।

৪) রাজ্যের বনাঞ্চলকে যথাযথ ব্যবহার করা এবং ভেষজ উদ্ভিদ সহ কিছু মশলাপাতির চাষ বৃদ্ধি করা—যাতে কসমেটিক্স, ঔষধী মশলা রপ্তানি করা যায়।

৫) রাজ্যে বর্তমানে অনেকগুলি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের শিল্প স্থাপন করা হয়েছে এবং সরকার আরও বেশী উদ্যোগী হচ্ছে।

৬) রাজ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার হওয়ায় জৈব খাদ্য রপ্তানীর প্রচুর সুযোগ রয়েছে।

৭) রাজ্যে বিভিন্ন প্রকার সুগন্ধি চাল, ডালশস্য, সবজি চাষের সুযোগ বেড়েছে।

৮) গ্রামীন কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে শৈথিল্য কাটিয়ে উঠে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।

(৯) বর্তমানে হাজার হাজার স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে যাদের নিয়ে ছোট ছোট ফেডারেশন বা দল করে জৈব কৃষির সম্প্রসারণ করা যাবে।

১০) আজকের সময়ের চাহিদা—উন্নত মানের খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্য সুরক্ষাকেও বহমান রাখা।

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় জৈব কৃষির সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং জৈব / বায়োমাস উৎপাদনের জন্য জৈবগ্রাম প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ২০০৩-০৪ ও ২০০৪-০৫ সাল থেকে কৃষকদের নিয়ে প্রশিক্ষণ চলছে এবং একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে জেলায় নতুন নতুন জৈবগ্রাম স্থাপনের সুযোগ রয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে প্রচুর পরিমাণে জীবাণুসার এবং জৈবসার ব্যবহার হয়েছে।

জাতীয় জৈব কৃষি প্রোজেক্ট (NPOF) এর অধীনে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ১০টি বেসরকারী সংস্থাকে সার্ভিস প্রোভাইডার (পরিষেবা প্রদানকারী) হিসাবে জৈব কৃষির কাজে কৃষকদের সাহায্য করার জন্য নথীভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি রাজ্যে ১০টি কৃষি খামারকে ২ হেক্টর জমিতে জৈব কৃষির মডেল হিসাবে স্থাপন করার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে।

তবে পশ্চিমবঙ্গে পুরোপুরি জৈব কৃষির ধারণা থেকে একটু সরে এসে অন্যভাবে কাজে লাগানোর কথা চিন্তা করা হচ্ছে। রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য পুরোপুরি জৈব কৃষির নিয়ম মেনে উৎপন্ন করা হবে। সেইভাবে শংসাকরণ করা হবে। আবার ভারতের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী জৈব কৃষি পণ্য উৎপাদন করা হবে। সেখানে নিয়মের কিছুটা শিথিলতা থাকবে এবং জৈব কৃষি পণ্যের প্রামাণ্য ভারতের বাজার অনুযায়ী হবে। তৃতীয় ধরনের বিকল্পে সুস্থায়ী কৃষির লক্ষ্যে কৃষি উপকরণ ব্যবহৃত হবে। এই বিকল্পে সর্বাধিক এলাকা আসবে, পরিবেশ, মাটি, জল দূষণ মুক্ত থাকবে, আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যও উৎপাদিত হবে।

এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে সেবা, ডি. আর. সি. এস. সি, প্রদান, কল্যাণ প্রভৃতি অ-সরকারি সংস্থা দীর্ঘদিন কৃষকের ক্ষেতে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে জৈব কৃষির কিছু মডেল উদ্ভাবন করেছে। ওই মডেলগুলি এলাকা বিশেষে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে।

পশ্চিমবঙ্গে জৈব কৃষির মডেল হিসাবে নির্বাচিত সরকারী কৃষি খামার

1) জেলা বীজ খামার, জলপাইগুড়ি।

2) জেলা বীজ খামার, কোচবিহার।

3) মহকুমা উপযোগী গবেষণা খামার, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগণা।

4) মহকুমা উপযোগী গবেষণা খামার, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর।

5) মহকুমা উপযোগী গবেষণা খামার, সিঙ্গুর, হুগলি।

6) জেলা বীজ খামার, পুরুলিয়া।

7) জেলা বীজ খামার, বর্ধমান।

8) রাজ্য কৃষি খামার, মালদা।

9) মহকুমা উপযোগী গবেষণা খামার বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা।

10) মহকুমা উপযোগী গবেষণা খামার ক্ষীর পাই, পশ্চিম মেদিনীপুর।

জৈব কৃষি রূপায়ণে পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা

১) জৈব কৃষিতে ফসল, প্রাণিসম্পদ ও কৃষি বনের সুসংহত বিকাশ লক্ষ্য হিসাবে রাখা হয়। একটি কৃষি খামারে কিংবা একজন চাষির পক্ষ্যে সবগুলির বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। আমাদের রাজ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক অধিক সংখ্যায় থাকায় তাদের জমিগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। অতএব, জৈব কৃষিতে সাফল্য লাভ করতে হলে কৃষকদের সমবায় কিংবা কৃষক গোষ্ঠী গঠন করা দরকার।

২) যদি এই মুহুর্তে জৈব কৃষি পদ্ধতি বৃহত্তর আকারে প্রয়োগ করা হয়, তবে তা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বৰ্দ্ধিত খাদ্যচাহিদা নিরসনে উপযোগী নাও হতে পারে এবং উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে। জৈব চাষের প্রথম কয়েক বছরে কৃষকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজন আছে।

(৩) উদ্ভিদ জাত কীটনাশকের কার্যকারিতা ধীর গতির হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই স্বল্পসময়ে কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায় না।

৪) জৈব ফসলের সংগঠিত ও নিশ্চিত বাজারের অভাবে কৃষকরা বঞ্চনার স্বীকার হতে পারে এবং সামগ্রিক ভাবে জৈব কৃষির সম্প্রসারণ ব্যহত হতে পারে।

৫) জৈব কৃষি শংসাপত্র সংগ্রহের মূল্য অনেক বেশী, যা রাজ্যের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়। দল বেঁধে শংসাকরণ (Group Certification) করার ব্যবস্থা করতে পারলে সুবিধা হয়।

৬) সব জৈব উৎপাদন ও উৎপন্ন দ্রব্যাদিকে একত্রিত করে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা দরকার।

৭) গ্রামাঞ্চলে প্রাণীসম্পদের সংখ্যা ক্রসমান হওয়ার কারনে ভবিষ্যতে জৈব উপকরণ প্রাপ্তিতে সমস্যা হতে পারে।

৮) কৃষির উৎপাদনশীলতা বহমান থাকা সত্ত্বেও আর উর্দ্ধগামী নয়, বরং কোথাও কোথাও এবং কোন কোন ফসলের ক্ষেত্রে নিম্নগামী।

৯) মাটির উর্বরাশক্তি ক্রমহ্রসমান এবং মাটিতে জৈববস্তু ও অণুখাদের ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

জৈব কৃষি রূপায়ণ

যখন কোন এলাকাকে জৈব কৃষিতে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তখন যে বিষয়গুলি ভেবে দেখতে হবে তা হল—

  • রাসায়নিক কৃষি উপকরণ কম ব্যবহৃত হয়, এমন এলাকা হবে।
  • বর্তমান শস্যবৈচিত্র বজায় থাকবে।
  • এলাকার জৈব উপকরণ সরবরাহের ক্ষমতা বা সুযোগ থাকবে।
  • খামার ব্যবস্থাপনায় কৃষি, উদ্যানবিদ্যা, রেশম চাষ, প্রাণী পালন, শূকর পালন, মৌমাছি পালন প্রভৃতির উপস্থিতি থাকবে।
  • স্বনির্ভর গোষ্ঠী / কৃষক সমবায়িকা / কৃষক সংগঠন / অ-সরকারী সংস্থার উপস্থিতি থাকবে।
  • কষি ক্ষেত্রটি শহরের বা বাজার এলাকার কাছাকাছি থাকবে।
  • উৎপন্ন জৈব পণ্য রপ্তানিযোগ্য হবে।
  • কৃষক তথা অন্যান্য সুবিধাভোগীদের স্বতঃপ্রণোদিত আগ্রহ ও অংশগ্রহণ থাকতে হবে।

জৈব কৃষির বিভিন্ন বিষয়গুলি একটি অপরটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং কাজও করে পারস্পরিকভাবে। একটি সক্রিয় জীবন্তবস্তু পূর্ণ মাটি ফসলে সরবরাহকারী পুষ্টি ও রোগ পোকা প্রতিরোধী মাধ্যম হিসাবে গড়ে ওঠে। একটি খামারের বিভিন্ন রসদের যথাযথ ব্যবহার, জৈব বৈচিত্র রক্ষা এবং গবাদি পশুর রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং কৃষিকে সুস্থায়ী করা যায়। জৈব কৃষিতে সর্বাধিক ফসল পাওয়ার লক্ষ্য থাকে না, বরং খামারের রসদগুলির যথাযোগ্য ব্যবহারের মাধ্যমে যতটা সম্ভব বেশি ফসল ফলানোর লক্ষ্য থাকে।

জৈব কৃষির ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়গুলি হলঃ

১) মাটিকে উদ্ভিদ খাদ্যে সমৃদ্ধ করা।

২) মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ।

৩) ভূমি ও বৃষ্টির জল সংরক্ষণ।

৪) সৌর শক্তির সর্বাধিক ব্যবহার।

৫) কৃষির উপকরণ তৈরিতে স্বনির্ভর হওয়া।

৬) বন্ধু পোকা-মাকড়ের সংরক্ষন এবং উপকারী জীবাণু ও পোকার ব্যবহার।

৭) ঘরোয়া গাছ-গাছড়ার মাধ্যমে শস্য সুরক্ষা।

৮) ফেরোমান ফাঁদ ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা।

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *