লংকা | মরিচ চাষ পদ্ধতি

লংকা

আগের বছর লংকা বা সমগোত্রীয় কোন ফসল চাষ হয়নি এরকম দোঁয়াশ মাটি যুক্ত উর্বর উঁচু জমি লংকা বীজ উৎপাদনের জন্য বেছে নিতে হবে। বীজ সংগ্রহ, বীজ শোধন থেকে শুরু করে ফসল তোলা, বীজ নিষ্কাশন, বীজ সংরক্ষণ প্রতিটি ক্ষেত্রে অনেক বেশী সতর্ক হওয়া দরকার।

লংকা বীজতলায় বীজ বোনার সময়

বীজতলায় বীজ বোনার সময়—ভালো মানের বীজ পেতে এমন সময় মূল জমিতে চারা রোপণ করতে হবে যাতে লংকা পাকার সময় শুষ্ক গরম আবহাওয়া থাকে। এজন্য জৈষ্ঠ্য মাসের ১৫ তারিখ থেকে আষাঢ় মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে বীজতলায় বীজ বোনা দরকার এবং ৪-৫ সপ্তাহ বয়সের চারা মূল জমিতে রোপণ করতে হবে। এই গাছে আশ্বিন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ফল ধরতে এবং আশ্বিনের শেষ থেকে লংকা পাকতে শুরু করবে।

লংকা বীজ সংগ্রহ এবং বীজ শোধন

বীজ সংগ্রহ এবং বীজ শোধন—বীজ উৎপাদনের ফসলের জন্য পরিবর্ধক বীজ (Breeder seed) বা আধারীয় বীজ (Foundation seed) আবশ্যক। একান্ত না পাওয়া গেলে কোন বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে শংসিত (Certified) বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বীজ বোনার আগে বীজ শোধন অবশ্যই করে নিতে হবে। দুই ভাবে বীজ শোধন করা যায়। শুকনো শোধন বা ভেজা শোধন।

লংকা বীজতলা তৈরী এবং শোধন

বীজতলা তৈরী এবং শোধন—বর্ষাকালে উঁচু জমিতে বীজতলা করা দরকার। ১ বিঘা জমি রোয়া করার জন্য ৪ ফুট চওড়া এবং ২৫ ফুট লম্বা ১ টি বীজতলায় বীজ ফেলতে হবে। বীজতলায় বীজ বোনার ৩ সপ্তাহ আগে প্রয়োজনীয় জৈব সার মাটির সাথে মিশিয়ে পরে শুকনো বিচুলি বা অন্য কোন লতাপাতা বীজতলার উপরে বিছিয়ে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিতে হবে। এই তাপে বীজতলার অনেক জীবাণু এবং পোকা-মাকড় ধ্বংস হবে।

এর পরে আরো ভালো করে শোধনের জন্য প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ১০ লিটার জলে ৬০ মি.লি. হারে ৪০ শতাংশ ফর্মালিন গোলা জলে বীজতলার মাটি ২-৩ ইঞ্চি গভীরতা পর্যন্ত ভিজিয়ে পলিথিন দিয়ে ৭-১০ দিন ঢেকে রাখতে হবে। এরপর পলিথিন সরিয়ে দিয়ে মাটি ভালো করে কুপিয়ে গ্যাস বরে করে দিতে হবে। এর ৭-১০ দিন পর ঐ বীজতলায় শোধন করা বীজ বোনা যাবে। এছাড়া শুধু মোটা, স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে বীজতলার মাটি ১০-১২ দিন ঢেকে রেখে রোদ খাওয়ালে ভিতরে যে প্রচণ্ড তাপের সৃষ্টি হয় তাতেও অনেক রোগ বীজাণু মারা যায়।

বীজের হার—প্রতি কাঠা জমির জন্য ১০-১২ গ্রাম বীজ লাগবে।

বীজতলায় বীজ বপণ এবং পরিচর্যা—বীজতলার মাটিতে বীজ বোনার আগে ৫০০ গ্রাম

১৫-১৫-১৫ সুফলা সার এবং ৫০-১০০ গ্রাম কার্বোফিউরান জাতীয় দানাদার কীটনাশক মেশাতে হবে। সেচের দরকার হলে ঝারির সাহায্যে হাল্কা সেচ দেওয়া দরকার। বীজতলা আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। বীজতলায় বিভিন্ন প্রতিষেধক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। চারা বের হওয়ার ৫-৭ দিন পরে প্রতি লিটার জলে ৪ গ্রাম করে কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ওষুধ এবং সঙ্গে ৩ মিলি নিমতেল মিশিয়ে স্প্রে করা দরকার। এর ১ সপ্তাহ পরে ০.২ মিলি/লি ইমিডাক্লোপ্রিড জাতীয় ওষুধ স্প্রে করে বিভিন্ন রস শোষক পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। চারা তোলার ৩-৪ দিন আগে আরো একবার স্প্রে করলে পরবর্তীতে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া বীজতলা হাল্কা নাইলন মশারী দিয়ে ঢেকে রাখতে পারলে পরবর্তী কালে ভাইরাস ঘটিত কুটে রোগের সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।

লংকা মূল জমি তৈরী এবং সার প্রয়োগ

মূল জমি তৈরী এবং সার প্রয়োগ—মূল জমিতে চারা লাগানোর ১০-১৫ দিন আগে বিঘা প্রতি ২০ গ্রাম জৈবসার প্রয়োগ করে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপরে মোট ৫ ৬ বার চাষ দিতে হবে এবং প্রথম দিকে বিঘা প্রতি ২ কেজি পি.এস.বি এবং ২ কেজি অ্যাজোটোব্যাক্টর এই জমিতে প্রয়োগ করা দরকার। চাষের সময় মূল সার হিসাবে ৬ কেজি নাইট্রোজেন, ৮ কেজি ফসফেট এবং ৮ কেজি পটাশ প্রয়োগ করতে হবে। চাপান সার হিসাবে ৩ কেজি নাইট্রোজেন সার দিতে হবে প্রথমবার গোড়ায় মাটি দেওয়ার সময়। বাকী ৩ কেজি নাইট্রোজেন দিতে হবে দ্বিতীয়বার গোড়ায় মাটি ধরানোর সময়।

বীজতলা থেকে চারা তোলা এবং মূল জমিতে চারা রোপণ—উন্নত মানের বীজ পেতে ২৫-৩০ দিন বয়সের চারা মূল জমিতে লাইনে বা সারিতে লাগানো হয়। চারা তোলার সময় শিকড় যাতে না ছেড়ে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখা দরকার। ২ ইঞ্চি গভীর করে সারি থেকে সারি ২ ফুট এবং চারা থেকে চারা ১.৫ ফুট দূরত্বে মূল জমিতে চারা লাগানো হয়। এই সময় প্রতি গর্তে ২-৩ গ্রাম কার্বোফিউরান ৩-জি প্রয়োগ করা দরকার। চারা লাগানোর পর পরই তাতে জল দিতে হবে। বিকালের দিকে চারা লাগাতে পারলে ভালো হয়।

অন্তরণ দূরত্ব (Isolation distance)— লংকার ক্ষেত্রে ঈতর পরাগ সংযোগ ঘটে তাই নির্দিষ্ট গুণের উন্নত বীজ পাওয়ার জন্য লংকার অন্য ক্ষেত থেকে বীজ তৈরীর ক্ষেত এর মধ্যে ৪০০ মিটার অন্তরণ দূরত্ব অবশ্যই রাখতে হবে।

ক্ষেত পরিদর্শন এবং অবাঞ্ছিত গাছের উচ্ছেদ—বীজ উৎপাদনের জন্য ক্ষেত সব সময় আগাছা মুক্ত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ক্ষেতে রোগ বা পোকার আক্রমণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকার ব্যবস্থ নেওয়া দরকার। নির্দিষ্ট জাতের ভালো বীজ পেতে কমপক্ষে ৩ বার ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে।

(ক) প্রথম পরিদর্শন—ফুল আসার আগে প্রথম পরিদর্শন করা হয়। এই সময়ে ভিন্ন

বৈশিষ্ট্যযুক্ত লংকা গাছ পাওয়া গেলে তা তুলে ফেলতে হবে। যেসব গাছে বেশী আগে ফুল আসবে সেগুলোও ক্ষেত থেকে তুলে ফেলতে হবে।

(খ) দ্বিতীয় পরিদর্শন—গাছে প্রথমে ফুল ফল এলে দ্বিতীয় পরিদর্শন করা হয়। এই সময় কোন গাছের ফুল, ফল এবং অন্য বৈশিষ্ট্য মূল জাতের সঙ্গে না মিললে সেগুলো ক্ষেত থেকে তুলে নিতে হবে।

(গ) তৃতীয় পরিদর্শন—ফল পরিপুষ্ট হলে তৃতীয় পরিদর্শন করা হয়। এই সময় লংকার আকার, রঙ এবং গাছের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য না মিললে ঐ গাছ ক্ষেত থেকে তুলে ফেলা হয়। যে প্রতিবার পর্যবেক্ষণের সময় ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত গাছ ক্ষেত থেকে তুলে ফেলতে হবে।

গুণগত মানের বীজ উৎপাদনে অণুখাদ্যের প্রয়োগ—অণুখাদ্যের অভাব হলে সেই বীজে ভালো অঙ্কুরোদগম হয় না এবং পুষ্ট হয় না, তাই গাছে অণুখাদ্যের অভাব জনিত লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিভিন্ন অণুখাদ্যের অভাবজনিত লক্ষণ ও প্রতিকার—

(ক) বোরণ—বোরণের অভাবে গাছের কচি অংশের বৃদ্ধি ব্যহত হয়। ফুল-ফল ঝরে পড়ে বা শুকিয়ে যায়। ফুল ও ফল কম ধরে। ২০ শতাংশ বোরণ প্রতি লিটার জলে ১ গ্রাম গুলে চারা রোয়ার ৪ সপ্তাহ পরে প্রথম বার এবং ৮ সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় বার স্প্রে করতে হবে।

(খ) জিংক–জিংকের অভাবে গাছের নীচের দিকের পাতা কমলা রঙের হয়ে ঝরে পড়ে। ডগার কচি পাতা কোঁকড়াতে শুরু করে। ফুল, ফল কম আসে। চিলেটেড জিংক ০.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে চারা রোয়ার ৩ সপ্তাহ এবং ৬ সপ্তাহের মাথায় দুবার স্প্রে করতে হবে।

বীজ উৎপাদনের জন্য ফল সংগ্রহ—অক্টোবর মাস থেকেই লংকা পাকতে শুরু করে এবং ৩ থেকে ৪ মাস পর্যন্ত লংকা থেকে বীজ পাওয়া যায়।

লংকা থেকে বীজ নিষ্কাশন এবং সংরক্ষণ–পাকা লংকা গাছ থেকে তুলে রোদে শুকানো হয়। লংকা শুকিয়ে গেলে সাধারণতঃ লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ফল থেকে বীজ আলাদা করে নেওয়া হয়। হাত দিয়ে বীজ নিষ্কাশন খুব কষ্টকর, তাই বেশী বীজ উৎপাদন করতে মেশিন ব্যবহার করতে হয়। বীজ নিষ্কাশনের পরে প্যাকেটে বা কোন পাত্রে শুষ্ক, ঠাণ্ডা জায়গায় রেখে শোধন করে বীজ সংরক্ষণ করা হয়।

বীজের ফলন—প্রতি বিঘা জমি থেকে ২৫ কেজি থেকে ৩৫ কেজি পর্যন্ত বীজ পাওয়া যেতে পারে।


 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *