ভেণ্ডী

ভেণ্ডী

দিনের বেশীর ভাগ সময় রোদ থাকে এবং হাওয়া চলে এমন উঁচু জমি এবং দোঁয়াশ বা পলি-দোঁয়াশ মাটি ভেণ্ডী বীজ উৎপাদনের জন্য বেছে নেওয়া দরকার। আগের বছর ভেণ্ডি চাষ হয়েছে এ’রকম জমি বীজ উৎপাদনের জন্য নির্বাচন করা উচিত নয়। বীজ উৎপাদনের ফসল চাষের জন্য বীজ সংগ্রহ, বীজ বাছাই, বীজ শোধন থেকে শুরু করে ফসল তোলা, বীজ সংগ্রহ প্রতিটি ক্ষেত্রে অনেক বেশী যত্নবান এবং সতর্ক হওয়া দরকার।

ভেণ্ডী বীজ সংগ্রহ

বীজ সংগ্রহ —বীজ উৎপাদনের জন্য পরিবর্ধক (Breeder seed) বীজ বা আধারীয় বীজ (Foundation seed) নিতে হবে। একান্ত না পাওয়া গেলে শংসিত বীজ (Certified seed) নেওয়া যেতে পারে। সব সময় বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।

ভেণ্ডী বীজ বাছাই এবং শোধন

বীজ বাছাই এবং শোধন—জলে ভিজিয়ে প্রথমে হাল্কা, অপুষ্ট বীজ বাদ দিতে হবে। এরপর পুষ্ট বীজে কোন বীজ শোধনের ওষুধ ভালো করে মাখিয়ে নিয়ে এক রাত্রি রেখে দিতে হবে। শোধনের জন্য প্রতি কেজি বীজে ২ গ্রাম কার্বেণ্ডাজিম বা থাইরাম বা ক্যাপটান জাতীয় ওষুধ মেশাতে হবে।

এছাড়া এম.ই.এম.সি-৬ শতাংশ জাতীয় ওষুধ ২ মিলি প্রতি লিটার জলে গুলে ঐ দ্রবণে

১ কেজি হারে বীজ জলে ৬-১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখার শেষ ১ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে বীজ শোধনের সাথে সাথে অঙ্কুরোদগমও ভালো হবে।

ভেণ্ডী বীজের পরিমাণ

বীজের পরিমাণ–এক বিঘা জমিতে সারিতে বোনার জন্য ভালো মানের ১.৫ কেজি থেকে ২ কেজি বীজ লাগে।

ভেণ্ডী মূল জমিতে বীজ বোনার সময়

মূল জমিতে বীজ বোনার সময়—সাধারণতঃ বছরে দু’বার ভেণ্ডি চাষ হয় তবে বর্ষাকালীন ফসল বীজ উৎপাদনের পক্ষে আদর্শ। এই সময়ে উৎপাদিত ফসল থেকে ভালো গুণগত মানের বীজ পাওয়া যায়। বর্ষাকালীন ফসলের জন্য জৈষ্ঠ্য মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে মূল জমিতে বীজ বুনতে হবে।

ভেণ্ডী মূল জমি তৈরী

মূল জমি তৈরী—ভেণ্ডী বীজ সরাসরি মূল জমিতে বোনা হয়, তাই মূল জমি অনেক যত্ন সহকারে তৈরী করতে হবে। চাষের শুরুতে বিঘা প্রতি ৮ থেকে ১০ কুইন্টাল জৈবসার মাটিতে প্রয়োগ করে চাষ দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। কয়েকদিন রোদ খাইয়ে জমির আগাছা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এতে মাটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন পোকা-মাকড় এবং রোগের জীবাণু নষ্ট হবে। এরপর আরো ৩-৪ বার জমি চাষ দিয়ে জমির মাটি ভালো করে তৈরী করতে হবে।

শেষ চাষের আগে বিভিন্ন পোকা মাকড় এবং ভাইরাস ঘটিত কুটে রোগ প্রতিরোধের জন্য বিধা প্রতি ৪ কেজি কার্বোফিউরান-৩ জি বা ১.২৫ কেজি ফোরেট১০ জি জাতীয় দানাদার কীটনাশক প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

এই সময়ে মূল সার হিসাবে ৭ কেজি নাইট্রোজেন, ৭ কেজি ফসফেট এবং ৭ কেজি পটাশ মাটিতে প্রয়োগ করে মিশিয়ে দিতে হবে।

ভেণ্ডী মূল জমিতে বীজ বপণ

মূল জমিতে বীজ বপণ—মূল জমিতে বীজ বোনার আগে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে অঙ্কুরোদগম ভালো হয়। সারিতে বীজ বুনতে হবে। সারি থেকে সারি ২ ফুট এবং গাছ থেকে গাছ ১ ফুট দূরত্বে রাখতে হবে। প্রতি খুপিতে ২ টি বীজ ১/২ থেকে ১ ইঞ্চি গভীরে বুনতে হবে। Q = 0 সপ্তাহ পরে নিড়ানি দেওয়ার সময় প্রতি খুপিতে একটি করে গাছ রাখতে হবে।

ভেণ্ডী চাপান সার প্রয়োগ এবং অন্যান্য পরিচর্যা

চাপান সার প্রয়োগ এবং অন্যান্য পরিচর্যা–চারা বেরনোর ২১ দিনের মাথায় প্রথম চাপান এবং ৪২ দিনের মাথায় দ্বিতীয় চাপান দেওয়া হয়। প্রতি চাপানে বিঘা প্রতি ৩.৫ কেজি নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করতে হবে। চাপান দেওয়ার আগে জমির আগাছা ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং পরে জলসেচ দিতে হবে।

বীজ উৎপাদনের জন্য সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষ করতে হবে। রোগ-পোকা প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন প্রতিরোধক ব্যবস্থা প্রথম থেকেই নিয়ে রাখতে হবে। এরপরেও কোন রোগ পোকার আক্রমণ দেখা দিলে সাথে সাথে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে রোগের ক্ষেত্রে অধিক সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে বীজের মাধ্যমে পরবর্ত্তী প্রজন্মে রোগ ছড়িয়ে পড়তে না পারে।

ভেণ্ডী অন্তরণ দূরত্ব

অন্তরণ দূরত্ব—ভেণ্ডির ক্ষেত্রে ঈতর পরাগ সংযোগ ঘটে তাই সঠিক গুণমানের বীজ উৎপাদনের জন্য অন্য ভেণ্ডি ক্ষেত থেকে বীজ উৎপাদনের ক্ষেতের মধ্যে কমপক্ষে 800 মিটার অন্তরণ দূরত্ব (isolation distance) বজায় রাখতে হবে।

ভেণ্ডী অণুখাদ্যের অভাব জনিত লক্ষণ ও প্রতিকার

অণুখাদ্যের অভাব জনিত লক্ষণ ও প্রতিকার  —বীজ উৎপাদনের ক্ষেতে অণুখাদ্যের অভাব জনিত লক্ষণ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। অণুখাদ্যের অভাব থাকলে পুষ্ট এবং গুণগত মানের বীজ উৎপাদন হয় না। তাই প্রথম থেকে মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে অণুখাদ্য প্রয়োগ করা না হলে এবং গাছে অণুখাদ্যের অভাব জনিত লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকার ব্যবস্থা নিতে হবে।

(ক) বোরণঃ এর অভাবে গাছের কচি অংশের বৃদ্ধি ঠিকমত হয় না। গাছে ফুল ও ফল কম আসে। ২০ শতাংশ বোরণ ১ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে গাছের ৪ সপ্তাহ এবং ৮ সপ্তাহ বয়সে দুবার স্প্রে করতে হবে।

(খ) মলিবডেনামঃ মলিবডেনামের অভাবে গাছের সবুজ অংশ কমে যায়। পাতা সরু হয়ে যায় এবং পাতা কিছুটা সাদা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। অ্যামোনিয়াম মলিবডেট ০.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে গাছের ১ মাস এবং ২ মাস বয়সে মোট দুবার স্প্রে করতে হবে।

(গ) ম্যাঙ্গানীজঃ ম্যাঙ্গানীজের অভাবে পাতা হলদে ও বাদামী রঙের হয়। ফলে ধূসর ও সাদা দাগ দেখা যায়। প্রতি লিটার জলে ৪ গ্রাম ম্যাঙ্গানীজ সালফেট এবং ২ গ্রাম কলিচুন মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

(ঘ) জিংকঃ জিংকের অভাবে পাতা বাদামী থেকে বেগুণী রঙের হয় ও পরে শুকিয়ে যায়। গাছের কচি পাতা কোঁকড়াতে আরম্ভ করে। গাছে ফুল ও ফল আসে না। চিলেটেড জিংক ০.৫-১ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে ৪ সপ্তাহ এবং ৮ সপ্তাহের মাথায় দুবার স্প্রে।

ক্ষেত পরিদর্শন এবং অবাঞ্ছিত গাছের উচ্ছেদ—সঠিক গুণমানের বীজ উৎপাদন করতে মোট তিন বার ক্ষেত পরিদর্শন করা হয় এবং এই সময় অবাঞ্ছিত (off type) গাছ গুলি ক্ষেত থেকে তুলে নেওয়া হয়। পরিদর্শনের সময় প্রতি গাছ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা দরকার।

প্রথম পরিদর্শন—ফুল আসার আগে প্রথম পরিদর্শন করা হয়। এই সময় পাতা এবং কাণ্ডের বৈশিষ্ট পর্যবেক্ষণ করা হয়। যে সব গাছের পাতা এবং কাণ্ডের বৈশিষ্ট নির্দিষ্ট জাতের গাছের সঙ্গে মেলে না সেগুলি ক্ষেত থেকে তুলে ফেলতে হবে। যেসব গাছে বেশী আগে বা বেশী পরে ফুল আসবে সেই সব গাছ ও তুলে ফেলতে হবে।

দ্বিতীয় পরিদর্শন—গাছে প্রথম ভেণ্ডি ধরতে শুরু করলে দ্বিতীয় পরিদর্শন করা হয়। এই সময় পাতা, ফল এবং কাণ্ডের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গে যেসব গাছে সাহেব রোগের (ভাইরাস ঘটিত মোজেইক রোগ) লক্ষণ দেখা যাবে, সেই গাছ গুলি সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিয়ে ক্ষেত থেকে দূরে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে বা পুড়িয়ে নষ্ট করতে হবে।

তৃতীয় পরিদর্শন—যখন ভেণ্ডি পরিপুষ্ট হয় সেই সময় তৃতীয় পরিদর্শন করা হয়। এই সময় যে গাছ গুলির বৈশিষ্ট, ফলের বৈশিষ্ট এবং বীজের বৈশিষ্ট নির্দিষ্ট জাতের সঙ্গে মেলে না, সেই সব গাছ ক্ষেত থেকে তুলে নেওয়া হয়।

ফল সংগ্রহ—প্রথম, দ্বিতীয় এবং শেষ পর্বের ফসল খাদ্য হিসাবে তুলে নিয়ে বাকী ফল থেকে বীজ উৎপাদন করলে বীজ উৎপাদন সর্বাধিক লাভজনক হয়। প্রথম, দ্বিতীয় এবং শেষ পর্বের ফলগুলি খাওয়ার জন্য তুলে নেওয়া যেতে পারে। বীজের ফলন এবং মান মূলতঃ ডেঙি তোলার উপর নির্ভর করে।

দেখা গেছে, প্রথম থেকেই গাছ থেকে কোন ভেণ্ডি না তুলে সবই বীজের জন্য রেখে দিলে গাছ প্রতি কম ফল আসে কিন্তু এক্ষেত্রে সব থেকে উৎকৃষ্ট মানের বীজ পাওয়া যায়।

যে সব ফল পেকে শুকিয়ে গেছে বলে মনে হবে সেই ফলগুলি বীজ উৎপাদনের জন্য তুলে নিতে হবে।

 

ফল থেকে বীজ সংগ্রহ এবং বীজ বাছাই—বীজের জন্য উপযুক্ত পরিপক্ক ফল তুলে নেওয়ার পর সেগুলি রোদে শুকানো হয়। রোদে ৩-৪ দিন শুকানোর পর ফলগুলি দণ্ডের সাহায্যে পিটিয়ে ফল থেকে বীজ বের করে নেওয়া হয়।

হাল্কা থেকে গাঢ় সবুজ রঙের বীজগুলিই সব থেকে উৎকৃষ্টমানের বীজ। কালো রঙের ছোট ও হাল্কা বীজ থেকে ভালো অঙ্কুরোদগম হয় না ও ভালো চারা পাওয়া যায় না। এই বীজ গুলি প্রথমেই বাদ দিতে হবে। এজন্য সমস্ত বীজ ৫-১০ মিনিট জলে ভিজিয়ে রাখলে হাল্কা, কালো, ছোট বীজ গুলি ভেসে থাকবে। সেগুলি বাদ দিতে হবে। নীচের ডুবে যাওয়া ভারী বীজ গুলি সংগ্রহ করতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভালো করে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।

বীজ শুকানো ও সংরক্ষণ করা—বীজ সংরক্ষণের আগে বীজ গুলিকে রোদে বা ড্রায়ার যন্ত্রে শুকিয়ে আর্দ্রতা ৮-১০ শতাংশ এর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এরপর বীজগুলি কোন মুখবন্ধ পাত্রে শুকনো ও অন্ধকার জায়গায় রেখে দিতে হবে। এইভাবে বীজ সংরক্ষণ করলে ২ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে। তবে, ছত্রাক নাশক দিয়ে বীজ শোধন করে রাখতে এবং মাঝে মাঝে রোদে দিয়ে পুণরায় শুকিয়ে নিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *