উৎপাদিত বীজের সংরক্ষণ পদ্ধতি

উৎপাদিত বীজের সংরক্ষণ

জৈব কৃষির প্রাথমিক মাপকাঠি ও ধারণা

বিজ্ঞান ভিত্তিক উপায়ে উৎপাদিত বীজ উৎপাদনের পর তা সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরী কারণ সংগৃহীত বীজ সাধারণতঃ পরের মরশুমে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

নানা ধরণের পোকা-মাকড়, রোগ-জীবাণু এবং ইঁদুর সংরক্ষিত বীজের ক্ষতি করে। এদের নিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা হ’ল

১) কেড়ি পোকা – এই পোকা ধান, গম, ভুট্টা এবং অন্যান্য দানাশস্যের পূর্ণাঙ্গ ও কীড়া অবস্থায় ক্ষতি করে। বাদামী বর্ণের এই পোকা গোল ছিদ্র করে শস্যের মধ্যে ঢুকে শস্যের ভেতরের অংশ খেয়ে ফেলে।

২) দানা ছিদ্রকারী পোকা – পূর্ণাঙ্গ ও কীট উভয়ই ধান, ভূট্টা, জোয়ার, মুসুর, ছোলা ইত্যাদি বীজের ক্ষতি করে। বীজ আক্রান্ত হলে শস্যের খোসার উপরে নানা আকৃতির ফুটো দেখা যায়।

৩) সুরুই পোকা – কীড়া অবস্থায় এই পোকা ধান, জোয়ার ও ভুট্টার ক্ষতি করে। সুরুই পোকা বিবর্ণ, হলদেটে বাদামী রং-এর, আকারে ছোট। সঞ্চিত বীজের ১ ফুট গভীরতার মধ্যে থাকে।

৪) মাজরা পোকা ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, তৈলবীজ ইত্যাদি শস্যে কেবল কীড়া অবস্থায় ক্ষতি করে। লালচে বাদামী বর্ণের পোকা, বীজের যে অংশে অঙ্কুর থাকে সেখান থেকে আক্রমণ করে। বর্ষাকালে বেশী ক্ষতি করে।

৫) ইঁদুর ভারতে জন প্রতি ১০টি ইঁদুর রয়েছে। ইঁদুর ১ বারে ২০ টি বাচ্চা দিতে পারে। ১ – জোড়া ইঁদুর এক বছরে ১২৭০ ইঁদুরের জন্ম দেয়। এরা যা খায় তার ২০ গুণ খাদ্য নষ্ট করে। নানা ধরণের ইঁদুরের মধ্যে-ক) ধেড়ে ইঁদুর মোটাসোটা, বড়, হিংস্র। দানা শস্য, আলু, চীনাবাদামের ক্ষতি করে। খ) বাড়ীর ইঁদুর। গ) নেংটি ইঁদুর সংরক্ষিত বীজের অন্যতম শত্রু।

জৈব কৃষি

রোগ পোকা, ইঁদুরের হাত থেকে গোলাজাত বীজের সংরক্ষণের উপায়—

১) বীজ ঝাড়াই করে ৩-৪ দিন রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে ও পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজের আর্দ্রতা কম রাখতে হবে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে আরেকবার বীজ শুকানো উচিত।

২) বস্তায় করে বীজ রাখলে মাচার উপর বা পাটাতন বা মোটা পলিথিন চাদরের উপর দেয়াল থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখা উচিত।

৩) বীজ মজুদ করার আগে গোলা ঘরের দেওয়াল, ড্রাম, জালা প্রভৃতি স্থানে অবশ্যই ১ লিটার ম্যালাথিয়ন (৫০ শতাংশ) ১০০ লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।

৪) অল্প পরিমাণ বীজ মজুদ করা প্রয়োজন হ’লে মাটির জালা, ধাতব শস্যাধার (seed bin), মোটা পলিথিনের ব্যাগ অথবা লোহার সীটের তৈরী পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।

৫) শুকনো, ঠাণ্ডা করা বীজে নিম্ন লিখিত পদার্থগুলো মিশিয়ে রাখলে বীজে রোগ-পোকা আক্রমণ প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

হলুদ গুঁড়ো০.৫ গ্রাম / কেজি বীজের জন্য।
লংকা গুঁড়ো১.০ গ্রাম / কেজি বীজের জন্য।
নিমপাতা গুঁড়ো২.০ গ্রাম / কেজি বীজের জন্য।
সরষের তেল১.০ মিলি / কেজি বীজের জন্য

৬) রাসায়নিক প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ –

ক) ম্যালাথিয়ন (৫০ ইসি) পোকা আক্রমণ হ’লে ১০০ বর্গমিটার জায়গার জন্য ১০ মিলি / লি. জলে গুলে ৩ লি. দ্রবণ স্প্রে করতে হবে

খ) ডেন্টামেথ্রিন (২৫ ডব্লু.পি.)- পোকার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বস্তা, দেওয়াল, মেঝে, ফাঁক ফোকরে ১ লিটার জলে ৪০ গ্রাম এই কীটনাশক এর দ্রবণ ১০০ বর্গ মিটার জায়গায় ৩ লি. স্প্রে করতে হবে।

৭) বস্তায় গুদামজাত করলে বস্তাগুলো ভালোভাবে ম্যালাথিয়ন দ্রবণ স্প্রে করতে হবে। প্রতি কেজির জন্য ৫ গ্রাম খাবার তেল মিশিয়ে রাখলে ৪-৬ মাস বীজ নিরাপদে রাখা যায়।

৮) ছত্রাকের আক্রমণ প্রতিরোধে থাইরাম বা ক্যাপটান গুঁড়ো ২ গ্রাম/কেজি বীজে ব্যবহার করা যায়। জীবাণুনাশক হিসাবে ব্লিচিং পাউডার- ২ গ্রাম/কেজি মাত্রায় প্রয়োগ করে বীজ আবদ্ধ পাত্রে রেখে ব্যবহার করা যায়।

৯) বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় কাজ না হলে ধূপন বিষ ব্যবহারের দরকার হয়। অ্যালুমিনিয়াম যেমন, কুইকফস্ ট্যাবলেট – ১২ গ্রাম/২৫০ কেজি বীজের জন্য প্রয়োজন হয়।

ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ

১) বীজ সংরক্ষণের জন্য ঘরের বা পাত্রের যে কোন ছিদ্র উপযুক্ত উপায়ে বন্ধ করতে হবে।

২) যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ – ক) নানা ধরণের ফাঁদ ব্যবহার করে ইঁদুর ধরা যায়। তবে প্রতিবার ফাঁদ ব্যবহারের পূর্বে তা ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে ব্যবহার করা উচিত। খ) আলকুশি ইঁদুরের চলার পথে ব্যবহার করলে ইঁদুরের শরীরে প্রচণ্ড চুলকানি হবে এবং ইঁদুর পালিয়ে যাবে।

৩) জৈব নিয়ন্ত্রণ-প্যাচা এক রাতে দুটি ইঁদুর মারতে পারে। ইঁদুরের রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া সালমোনেলা টাইফিমিউরিয়াম কৃত্রিমভাবে প্রয়োগে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

৪) রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ জিংক ফসফাইড দিয়ে বিষটোপ তৈরী করতে হয়। প্রথমে ১-২ দিনভালো খাবার দিতে হবে। পরে নিম্নলিখিত উপাদান দিয়ে তৈরী করে প্রয়োগ করতে হবে।

উপাদানবিষ ছাড়া (গ্রাম)বিষ সহ (গ্রাম)
(১) ভাঙ্গা চাল৪৮৪৮
২) গমের আটা৪৮৪৮
৩) ভোজ্য তেল০৪০২
৪) জিংক ফসফাইড০২
১০০ গ্রা:১০০ গ্রা:

৫-১৫ গ্রাম টোপ ইঁদুরের চলার পথে অল্প আড়াল করে কাগজে মুড়ে ফেলে রাখতে হবে। প্রথম ১-২ দিন বিষহীন টোপ দেওয়ার পরে একদিন বিষটুক্ত টোপ দিতে হবে। অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ব্যবহার—এই রাসায়নিকটি হল ব্রোমোডাইওলান (০.৫ শতাংশ)। এটি বাজারে রোবান, মর্টিন নামে বিক্রি হয়। ছোট ছোট কেকের আকারের এই রাসায়নিকটি সরাসরি ইঁদুরের খাবার হিসাবে ব্যবহার করার সুবিধে রয়েছে। এটি খেলে ইঁদুরের মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব হয় এবং ফাঁকা জায়গায় ইঁদুরের ২-৩ দিনে মৃত্যু হয়। খরচ বেশী হলেও ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের এটি সবচেয়ে সহজ উপায়।

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *