জৈব কৃষি

জৈব কৃষি

জৈব কৃষি

স্বাধীনতা পরবর্ত্তী সময়ে কৃষি-উৎপাদনে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। দেশের মানুষের মুখে দুবেলা দুমুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে অন্ধের যষ্ঠির মত আঁকড়ে ধরা হয়েছে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের মত চট্জলদি লাভদায়ক কৃষি উপকরণকে। ১৯৫২-৫৩ সালে দেশে খাদ্য শস্য উৎপন্ন হয়েছিল ৫২ মিলিয়ন টন এবং তার জন্য রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়েছিল মাত্র ৭০ হাজার টন। চাহিদা ও যোগানের টানাপোড়েনে ১৯৯৯-২০০০ সালে দেশে মোট খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়েছিল ২০৬ মিলিয়ন টন এবং তার জন্য রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়েছিল মাত্র ১৮ মিলিয়ন টন। ফসল মাটি থেকে তুলে নিয়েছিল ২৮ মিলিয়ন টন খাদ্যকণা। অর্থাৎ, প্রয়োজনের তুলনায় রাসায়নিক সার যে বেশী ব্যবহৃত হয়েছিল তা নয়, ব্যবহৃত হয়েছিল অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় ও অনিয়মিতভাবে। বিগত পঞ্চাশ বছরে কৃষি ক্ষেত্রে যে হারে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বেড়েছে তার চেয়ে অধিক হারে কমেছে জৈব সারের ব্যবহার। শস্য নিবিড়তা বাড়ায় কমেছে গোচারণ ক্ষেত্র, শস্যাবশেষ ও গোবর-গোমূত্র ব্যবহৃত হয়েছে অকৃষিকাজে বা নষ্ট হয়েছে অব্যবহারে। ফলে, দিনে দিনে মাটিতে জৈব পদার্থের ভাণ্ডারে টান পড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই জমি তার উর্বরাশক্তি হারাচ্ছে অতি দ্রুত, মাটি হারাচ্ছে তার স্বাস্থ্য। ফলে, কৃষক আজ যথেষ্ট পরিমান রাসায়নিক সার ব্যবহার করেও আর আশানুরূপ ফলন পাচ্ছে না। দিনের পর দিন অনিয়ন্ত্রিত আর বেহিসেবী রাসায়নিক সার, কীটনাশক, আগাছা নাশক ইত্যাদি রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে মাটি হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক গঠন, প্রথন, জলধারণ ক্ষমতা, ক্ষারাম্লমান; মাটিতে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে উপকারী জীবাণুর। এভাবে চলতে থাকলে মাটি আর কিছুই ফেরৎ দেবে না-হয়ে যাবে অনুর্বর, বন্ধ্যা। উৎপন্ন ফসল হবে রাসায়নিক অবশেষযুক্ত বিষাক্ত এবং পরিবেশ হবে কলুষিত। এমতাবস্থায় কৃষিকাজে বিকল্প কিছু পদ্ধতির চিন্তাভাবনা চলছে। জৈব কৃষি সেই চিন্তাভাবানার একটি ফসল। কারণ, সবার জন্য খাদ্য, সবার জন্য পুষ্টি ও দূষণমুক্ত পরিবেশ চাই। আবার, পৃথিবীকে খাদ্য যোগানোর মূল ধারক ও মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সম্বল মাটিকে রক্ষা করা জরুরি।

জৈব কৃষি মাটিকে উদ্ভিদ খাদ্যে

পশ্চিমবঙ্গে কৃষির কিছু বৈশিষ্ট ও জৈব কৃষি প্রসারের অনুকূল অবস্থা

জৈব কৃষির ক্রমবিকাশ

জৈব কৃষির প্রচলন হাজার হাজার বছর আগে শুরু হয়েছিল কৃষির সূচনাকালেই। বিশ্বের মানচিত্রে মেসোপটেমিয়া এবং হোয়াংহো অববাহিকাতে ১০,০০০ বছর আগে, নিয়োলিথিক যুগে, প্রাচীন সভ্যতায় যে কৃষির উল্লেখ পাওয়া যায় তা ছিল জৈবকৃষি। আমাদের দেশে রামায়ণে উল্লেখ আছে—সব মৃত বস্তুই পচন ক্রিয়ার মাধ্যমে জীবনের প্রতিপালনী শক্তি হিসাবে কাজ করে। ৬০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দতে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে প্রাণীর মলমূত্র, খইল সহ নানা জৈবসারের উল্লেখ পাওয়া যায়। বরাহ মিহিরের সংহিতাতে বিভিন্ন ফসলে জৈবসারের নির্বাচন ও ব্যবহার বিধির উল্লেখ রয়েছে। ২৫০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে ঋক্‌বেদ-এ জৈবসার, সবুজসার এর উল্লেখ করে। বলা হয়েছে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল বৃদ্ধির জন্য ফসল ক্ষেতে ছাগল, ভেড়া, গোরুর মলমূত্র, জল এবং এমনকি মাংসও প্রয়োগ করা উচিৎ। ৫৯০ খ্রীষ্টাব্দে পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে, ‘তুমি মাটি থেকে যা তুলে নাও (চাষের মাধ্যমে) তার এক তৃতীয়াংশ (পুনরাবর্তন বা শস্যাবশেষ প্রয়োগের মাধ্যমে) মাটিতে ফিরিয়ে দিও, অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আবহমান কাল ধরে এদেশে জৈব কৃষির চর্চা তথা প্রচলন হয়ে আসছে।

পরবর্তীকালে স্যার অ্যালবার্ট হাওয়ার্ড (১৯৩০) জমিতে কম্পোস্ট প্রয়োগ করে সর্ব প্রথম আধুনিক জৈব খামার শুরুর ধারণা দিয়ে ছিলেন বলে তাঁকে আধুনিক জৈব কৃষির জনক বলা হয়। এরপর জার্মান আধ্যাত্মবাদী দার্শনিক রুডলফ স্টেইনার বায়োডায়নামিক ফার্ম গড়ে তোলেন। ১৯৫০ সালে আমেরিকায় জে.আই. রোডেল টেকসই বা সুস্থায়ী কৃষি এবং জৈব চাষ চালু করেন। ওই সালেই জার্মানীতে প্রতিষ্ঠিত হয় জৈব কৃষি আন্দোলনের আন্তর্জাতিক সংঘ (IFOAM)। ১৯৭৫ সালে জাপানের স্বনামধন্য অণুজীব বিজ্ঞানী মাসানোবু ফুকোওকা ‘ওয়ান স্ট্র রিভোলুশন’ ( One Straw Revolution) নামক বইটি প্রকাশ করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৯৯ সালে জৈব খাদ্যের আইন প্রচলন করে (EU Regulation) এবং ১৯৯৯ সালে প্রবর্তিত হয় জৈব মান এর আন্তর্জাতিক দিক নির্দেশিকা কোডেক্স (CODEX)। ভারতবর্ষে ২০০৩ সালে মধ্যপ্রদেশের গাজিয়াবাদে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ অর্গানিক ফার্মিং। APEDA, Spices Board, Coconut Dev Board, Dte of Cashew and cocoa র মতো সরকারী সংস্থা এবং আধাসরকারী ও বেসরকারী জৈব সংস্থার জন্য বেঁধে দেওয়া হয় জৈব উৎপাদনের মানদন্ড ইন্ডিয়া অর্গানিক’। ২০০০ সালে চালু হওয়া ন্যাশনাল প্রোগ্রাম যার অর্গানিক প্রোডাকশান (NPOP) এর মুখ্য উদ্দেশ্য মুখ্য পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ প্রদান। শুরু হয় জৈব ফসল উৎপাদন ও সংশিতকরণ। ২০১৫-১৬ সালে পরম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা (PKVY)-এর মাধ্যমে জৈব চাষে উৎসাহ প্রদানের পাশাপাশি পিজিএস সার্টিফিকেশন পদ্ধতিতে দেশীয় বাজারে জৈব পণ্য সবরবরাহের পরিকল্পনা হয়।

জৈব কৃষি কি ?

জৈব কৃষি হল জৈব উপকরণের সমন্বয়ে চাষবাস—–শিল্পজাত তথা রাসায়নিক উপকরণ ও জিন পরিবর্তিত ফসল ব্যতিরেকে চাষবাস; স্থানীয় প্রযুক্তি ও সহজলতা উপকরণগুলি ব্যবহার

করে বহমান উৎপাদন ব্যবস্থা বজায় রাখা, ফসলের অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়ে বাকি জৈববস্তুর পুনরাবর্তনের মাধ্যমে চাষবাস; কৃষি বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক গতি বজায় রাখা, জৈব বৈচিত্র ও জৈবচক্র, মাটির মধ্যের জীবন্ত বস্তুর ক্রিয়া বজায় রাখা, শস্য রক্ষায় পরিচর্যাগত, জৈবিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতির সার্বিক সমন্বয় ঘটানো; শুধুমাত্র চাষবাস নয়, মিশ্র খামার পদ্ধতি অর্থাৎ একই সঙ্গে কৃষি, প্রাণী পালন, মাছ চাষ প্রভৃতির সমন্বয় ঘটানো। ফলে, জৈব কৃষির অন্যতম লক্ষ্য জৈববস্তুগুলির কার্যকরী ব্যবহার ও পুনরাবর্তন করা।

জৈব কৃষির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হলঃ

(১) প্রকৃতির কাছে অচেনা বস্তু যেমন, জিনপরিবর্তিত বস্তু, রাসায়নিক সার ও রাসায়নিক কীটনাশক/রোগনাশক/আগাছানাশক ব্যবহার না করা।

২) স্থানীয় ও পুনরাবর্তনযোগ্য উপকরণের ওপর প্রাথমিকভাবে নির্ভর করা।

৩) কৃষিক্ষেত্র ও চারপাশে ফসলের জৈব বৈচিত্র রক্ষা করা।

৪) মাটির মধ্যে জৈব বস্তুর পরিমান বৃদ্ধি ও জীবাণু (উপকারী) দের

সক্রিয়তা বৃদ্ধি।

৫) মাটির উর্বরতা ও ফসলের উৎপাদনশীলতা বজায় রাখা।

৬) মাটি, জল ও বায়ুর দুষণ কমিয়ে স্বাস্থ্যকর অবস্থায় রাখা। মানুষ ও পশুপাখীর স্বাস্থ্য ভাল রাখা। জৈব কৃষির চিন্তার পাশাপাশি রাসায়নিক সার ও কৃষিবিষের ওপর একান্তভাবে নির্ভরতা কমানোর জন্য নানা পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়। ফসলের সুসংহত ব্যবস্থাপনায় (আই সি এম) ফসলের সুস্বাস্থ্য বজায় রেখে ফলন বাড়ানো হয়। ফসলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে বেশি করে জৈব উপকরণের ওপর নির্ভর করে রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহার কমানো হয়। আবার সুসংহত রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণের যান্ত্রিক, পরিচর্যা, জৈবিক পদ্ধতিগুলির সার্থক প্রয়োগের পরে শেষ ধাপে প্রয়োজনে কিছু পরিবেশ বান্ধব রাসায়নিক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এন.পি.এম হল, কোন প্রকার রাসায়নিক কৃষি বিষ প্রয়োগ ছাড়া রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণ। এ পদ্ধতিতে ফসল চাষের নানা প্রকার শত্রু নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রয়োগ দ্বারা ও রাসায়নিক কৃষি বিষ প্রয়োগ ছাড়া রোগ-পোকা-আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রকৃত জৈব কৃষিতে কৃষির সমস্ত উপকরণই জৈবিক হবে। গৃহপালিত পশুর মলমূত্র, ফসলের অবশিষ্টাংশ, আবর্জনা সার, কেঁচো সার প্রভৃতি জৈব সার ফসলের পুষ্টিতে লাগবে। উদ্ভিদজাত ও জীবাণুজাত কীটনাশক শস্যরক্ষাতে ব্যবহার করতে হবে। ফসল, প্রাণীসম্পদ, কৃষি ও বনের সুসংহত মেলবন্ধন ঘটিয়ে জৈববস্তুর পুনরাবর্তন করতে হবে। উৎপন্ন জৈব কৃষিজাত দ্রব্য নির্দিষ্ট সংস্থা বা এজেন্সির কাছ থেকে শংসাপত্র সংগ্রহ করে তবেই জৈব কৃষিজাত দ্রব্য হিসাবে বিক্রি করা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *