জৈব কৃষির প্রাথমিক মাপকাঠি ও ধারণা
ব্যক্তি তথা সমাজের স্বার্থে প্রকৃতিতে দীর্ঘকাল ধরে চলা নিয়মের সঙ্গে আমাদের এখনকার চাহিদা এক সুরে বাঁধা প্রয়োজন। চাষীকে বর্তমান কৃষির বাধ্যবাধকতা ও আগামী দিনের লক্ষ্য বোঝানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
পৃথিবীর অন্ন জোগানের যে ক্ষেত্র হল মাটি, তার সুস্থায়ী স্বাস্থ্য বজায় রাখা প্রয়োজন। মাটিতে জৈব বস্তুর প্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। কেন না ভারতে তথা পশ্চিমবঙ্গের মতো উষ্ণ অঞ্চলের মাটিতে জৈব কার্বনের উপস্থিতি প্রায় ০.৫ শতাংশ, যেটা থাকা উচিত ছিল ৫ শতাংশ। শীত বা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ তথা জৈব কার্বন থাকায় আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগ তেমন সমস্যা সৃষ্টি করে না। মাটিতে জৈব বস্তু প্রয়োগের ফলে মাটির অভ্যন্তরে থাকা জীবিত বস্তু সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন কৃষি হয়ে ওঠে একটি জীবন্ত বাস্তুতন্ত্র। তখন রাসায়নিক উপকরণের বিকল্প হিসাবে জৈব কৃষিকে ভাবা যেতে পারবে। জৈব কৃষিকে উপযুক্তভাবে প্রয়োগ করলে প্রাকৃতিক দূষণ ঘটবে না এবং মাটিও স্বাভাবিক অবস্থার মতো দূষণহীন থাকবে। জৈব কৃষি আন্দোলনে আন্তর্জাতিক ফেডারেশন (IFOAM – International Forum for Organic Agricultural Movements) ১৯৯২ সালে ব্রাজিল সম্মেলনে জৈব কৃষির প্রাথমিক বিষয় লিপিবদ্ধ করেছে। লিপিবদ্ধ জৈবকৃষির মূল লক্ষ্যগুলি হল—
পশ্চিমবঙ্গে কৃষির কিছু বৈশিষ্ট ও জৈব কৃষি প্রসারের অনুকূল অবস্থা
(১) যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিমূল্যের খাদ্য দ্রব্য তৈরী করা।
২) উৎপাদন কর্মসূচীতে প্রাকৃতিক পদ্ধতি ও উপকরণের ব্যবহার করা।
৩) মাটির সঙ্গে জড়িত সমস্ত অণুজীব, ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও অন্য উদ্ভিদ, প্রাণী প্রভৃতি জৈবিক চক্রস্থিত উপাদানের সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি ঘটানো।
৪) মাটির দীর্ঘকালীন উর্বরতা বজায় রাখা।
৫) কৃষি নির্ভর সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বস্তুর ব্যবহার।
৬) কৃষি কাজ থেকে উদ্ভূত সকল প্রকার দূষণ যতটা সম্ভব কমানো।
৭) কৃষির পারিপার্শ্বিক অন্য উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সঙ্গে জড়িত জৈব বৈচিত্র বজায় রাখা।
৮) মানবিক অধিকার অনুসারে কৃষি উৎপাদকের জীবন ধারণ, তাদের প্রাথমিক চাহিদা মেটানো এবং নিরাপদ কৃষি কাজের পরিবেশের মধ্যে কৃষকদের যথোপযুক্ত প্রতিদান ও মানসিক প্রশান্তি প্রদান করা।
৯) কৃষিকাজে সমাজ ও প্রকৃতির বিভিন্ন উপকরণের ব্যবহারযোগ্যতা বিবেচনা করা।
জৈব কৃষি পদ্ধতিতে কিছু কিছু প্রবণতা বা বিষয়কে কম প্রাধান্য দেওয়া বা এড়িয়ে চলার সুপারিশ রাখা হয়েছে, যাতে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যায় ও একই সাথে লক্ষ্য পূরণও হয়।
গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশের লক্ষ্যে জৈবকৃষির সুবিধা
1) জৈব পণ্য স্বাস্থ্যের পক্ষে ও পরিবেশের পক্ষে সম্পূর্ণ নিরাপদ।
2) জৈব ও জীবাণুসার সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং মাটিতে বা ফসলে রাসায়নিক দূষণ ঘটায় না এবং অপচয় কম হয়।
3) রাসায়নিক সারের অপচয় অনেক বেশী হয় এবং তা মাটির পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ জলেরও দূষণ ঘটায়।
4) জৈব ও জীবাণুসারের কার্যকারিতার জন্য খুব সামান্যই জল লাগে কিন্তু রাসায়নিক সারের অণুগুলি বিশ্লিষ্ট হয়ে কার্যকর হওয়ার জন্য অনেক বেশী পরিমাণে জল লাগে।
5) রাসায়নিক কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা উল্লেখ না করেলেও চলে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাসায়নিক সার ও রাসায়নিক কীটনাশক মিলে মাটিতে ও ফসলে নানা ধরণের জটিল ও বিষাক্ত তথা ক্ষতিকারক যৌগ তৈরী করে।
6) এদেশে প্রাকৃতিক ভাবে পড়ে থাকা বন-জঙ্গল, সামাজিক বনাঞ্চল, পতিত জমি বা চাষযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ নেহাৎ কম নয়। ঐ সব জমিকে সহজেই জৈব কৃষির আওতায় এনে চাষের এলাকা তথা উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়।
7) বাণিজ্যিক তথা প্রথাগত চাষের জমিকে অল্প অল্প করে ধাপে ধাপে জৈব কৃষির আওতায় আনা যায়।
8) জৈব উৎপাদন স্বাস্থ্য সম্মত হওয়ায় ধীরে ধীরে মানব সম্পদ ও গো-সম্পদ তথা প্রাণী সম্পদ সুরক্ষিত হবে, ফলে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ব্যয় কমে যাবে।
9) জৈব কৃষির আরেকটি উল্লেখযোগ্য শর্ত হলো জৈব বৈচিত্র। এরফলে বৈচিত্রময় জৈব সম্পদ সংরক্ষিত হবে এবং সমৃদ্ধ হবে। পাশপাশি, স্বাভাবিক নিয়মেই রোগ-পোকা আগাছা জনিত সমস্যা কমবে।
১০) প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশী এবং ধাপে ধাপে ভর্তুকী কমার ফলে কৃষি উপকরণের অত্যাধিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়বে। তাছাড়া প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদন বৃদ্ধির হার নিম্নমুখি। মাটির উর্বরতা শক্তিকে ধরে রেখে টেকসই বা চিরায়ত কৃষি ব্যবস্থার জন্য জৈব কৃষিই হতে পারে একমাত্র বিকল্প।
জৈব কৃষি ব্যবস্থাপনা প্রসারের জন্য করণীয় বিষয়
(1) উৎপাদক ও ক্রেতার মধ্যে জৈব কৃষির উপযোগিতা সম্বন্ধে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
(২) সরকারী নীতি ও প্রকল্প এমনভাবে প্রণয়ন ও কার্যকর করা যাতে তা উপভোক্তা অর্থাৎ উৎপাদক ও ক্রেতার যথার্থ উপকারে লাগে।
(৩) জৈব উপকরণের উৎপাদন ও বিপণন সুনিশ্চিত করা—–সঠিকমানের জৈব উপকরণ— বিশেষতঃ জৈব ও জীবাণু সার এবং শস্য সংরক্ষক এর অপ্রতুলতা প্রকট। আগ্রহী কৃষক প্রায় ক্ষেত্রেই হাতের কাছে উপযুক্ত গুণমানের প্রয়োজনীয় জৈব উপকরণ পায় না।
(৪) উন্নত মানের ও উপযুক্ত পরিমাণে করার জৈব উৎপাদন জন্য গবেষণা ও সম্প্রসারণ ব্যবস্থাকে আরও কার্যকরী, শক্তিশালী ও খামার মুখী করে উচ্চফলন সুনিশ্চিত ও সহজ লভ্য করা।
(৫) সংশাকরণ ও নিয়ন্ত্রণ জৈব উৎপাদনের প্রথম শর্তই হলো তা হবে আন্তর্জাতিক মানের এবং উপযুক্ত সংস্থার দ্বারা সংশাপত্র প্রাপ্ত। অথচ এরাজ্যে আজও তেমন কোন স্বীকৃত সংস্থাই নেই। পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সংশাপত্রে প্রাপ্ত পণ্য রপ্তানী হবে ও অধিক মূল্য পাবে–উৎপাদক তথা কৃষক লাভবান হবে এবং অচিরেই জৈব কৃষির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই ধরণের উপযুক্ত পরিকাঠামো ও পরিবেশ তৈরী করা আশু প্রয়োজন।
(৬) তথ্যের আদান-প্রদান (Information Exchange)— জৈব উৎপাদক ও বিপণনকারীদের মধ্যে নিয়মিত তথ্যের আদান-প্রদান অত্যন্ত জরুরী। আপাততঃ আন্তর্জাতিক বাজার তথা বিশ্বের কৃষিক্ষেত্রের না হলেও দেশীয় বাজার তথা বিভিন্ন রাজ্যের কৃষি ক্ষেত্রে জৈব চাষের অগ্রগতি সম্বন্ধে খুঁটি নাটি তথ্য কৃষকের দোড় গোড়ায় পৌঁছালে একদিকে যেমন কৃষক নিশ্চিন্ত মনে চাষ করতে পারবে অন্যদিকে লাভজনক চাষের প্রকৃত দিশা নিয়ে পথ চলতে পারবে।
(৭) ভবিষ্যৎ প্রসারের সম্ভাবনা (Future Prospect)—জৈব কৃষির ব্যাপক-বিশাল-বিস্তৃত সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাস্থ্য সচেতন বিশ্ব, বিশেষতঃ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলি জৈব কৃষির দিকে তাকিয়ে আছে চাতকের দৃষ্টিতে। টেকসই তথা চিরায়ত কৃষির লক্ষ্যে জৈব কৃষির দিকে ক্রমে ক্রমে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া ভবিষ্যৎ কৃষির জন্য আর কোন বিকল্পও নেই। তাই, সচেতনভাবে, সুপরিকল্পিত উপায়ে সমন্বিত প্রয়াসে সকলকে এগিয়ে যেতে হবে। তার জন্য ব্যাপক প্রচার, প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
জৈব কৃষি প্রবর্তনের পথে প্রথম পদক্ষেপেই যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তা হলো, জৈব কৃষির মাধ্যমে কি সবার মুখে অন্ন জোটানো সম্ভব? উদ্ভিদ খাদ্যের / পুষ্টির পুরোটাই কি জৈব ও জীবাণুজাত সার এর মাধ্যমে মেটানো সম্ভব? জৈব কৃষি কি লাভ জনক? নিম্নোক্ত পরিসংখ্যান কিন্তু অনেকগুলো প্রশ্নেরই সরাসরি উত্তর দিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে দীর্ঘদিন লাভজনক উপায়ে প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষ করতে করতে এবং অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগ করতে করতে মাটির উর্বরতাশক্তি হয়েছে অনেকটাই হ্রাসপ্রাপ্ত; একদিনে তা পূর্বাবস্থায় আসা সম্ভব নয়। প্রয়োজন ধীর অথচ দৃঢ়, ধৈর্য্যশীল পদক্ষেপ। ধাপে ধাপে রাসায়নিককে সরিয়ে জৈব জায়গা করে নিলে একদিন জৈব উপাদানেও রাসায়নিক এর সমান উৎপাদন সম্ভব হবে। উচ্চ ফলনশীল ও সংকর জাতের অধিকাংশ ফসলই বেশী বেশী মাত্রায় মাটি থেকে খাদ্য তথা পুষ্টি গ্রহণ করে। অনেক সময় শুধুমাত্র জৈব ও জীবাণু সার প্রয়োগে তার পূরণ নাও হতে পারে। তাই প্রাথমিকভাবে দেশীয় উচ্চফলনশীল জাত এবং অপেক্ষাকৃত কম খাদ্য/পুষ্টি টানে এমন ধরণের ফসল বেছে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নির্বাচিত ক্ষেত্রে সীমিত পরিমাণে নির্বাচিত ফসলের নির্বাচিত জাত নিয়ে জৈব চাষে অগ্রসর হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। জৈব কৃষি অবশ্যই লাভজনক। প্রাথমিকভাবে উৎপাদন ব্যয় একটু বেশী হলেও পণ্যের অধিকমূল্য সুনিশ্চিত করতে পারলে ১-২ বছর পর থেকেই জৈব চাষ লাভজনক হবে।
প্রথাগত চাষ ও জৈব চাষ এর তুলনামূলক পরিসংখ্যান
বৎসর | অবস্থান | ফলন কু:/হে: | মোট আয় (‘০০০টাকায় | অতিরিক্ত আয় (২০%) | মোট আয় (‘০০০ টাকায় | প্রকৃত আয় (০০০তাকায়) | প্রথাগত অপেক্ষা বেশি/কম |
প্রথাগত | — | ১০ | ২০ | ০ | ২০ | ৯ | ০ |
প্রথম | পরিবর্তনের বছর | ৫ | ১০ | ০ | ১০ | .৭৫ | -৮.২৫ |
দ্বিতীয় | ঐ | ৫.৭৫ | ১১.২৫ | ০ | ১১.২৫ | ৩.৭৫ | -৫.২৫ |
তৃতীয় | জৈব | ৬.২৫ | ১১.৫০ | ২.৫ | ১৫.০০ | ৭.০০ | -১.৫০ |
চতুর্থ | জৈব | ৭.৫০ | ১৫.০০ | ৩.০ | ১৮.০০ | ১০.৫০ | ১.৫০ |
পঞ্চম | জৈব | ৮.৭৫ | ১৭.৫০ | ৩.৫ | ২১.০০ | ১৩.৫০ | ৪.৫০ |
ষষ্ঠ | জৈব | ১০.০০ | ২০.০০ | ৪.০ | ২৪.০০ | ১৬.৫০ | ৭.৬০ |