জৈব কৃষি রূপায়ণ

জৈব কৃষি রূপায়ণ

যখন কোন এলাকাকে জৈব কৃষিতে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তখন যে বিষয়গুলি ভেবে দেখতে হবে তা হল

  • রাসায়নিক কৃষি উপকরণ কম ব্যবহৃত হয়, এমন এলাকা হবে।
  • বর্তমান শসাবৈচিত্র বজায় থাকবে।
  • এলাকার জৈব উপকরণ সরবরাহের ক্ষমতা বা সুযোগ থাকবে।
  • খামার ব্যবস্থাপনায় কৃষি, উদ্যানবিদ্যা, রেশম চাষ, প্রাণী পালন, শূকর পালন, মৌমাছি পালন প্রভৃতির উপস্থিতি থাকবে।
  • স্বনির্ভর গোষ্ঠী / কৃষক সমবায়িকা / কৃষক সংগঠন / অ-সরকারী সংস্থার উপস্থিতি থাকবে।
  • কষি ক্ষেত্রটি শহরের বা বাজার এলাকার কাছাকাছি থাকবে।
  • উৎপন্ন জৈব পণ্য রপ্তানিযোগ্য হবে।
  • কৃষক তথা অন্যান্য সুবিধাভোগীদের স্বতঃপ্রণোদিত আগ্রহ ও অংশগ্রহণ থাকতে হবে।

জৈব কৃষির বিভিন্ন বিষয়গুলি একটি অপরটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং কাজও করে পারস্পরিকভাবে। একটি সক্রিয় জীবন্তবস্তু পূর্ণ মাটি ফসলে সরবরাহকারী পুষ্টি ও রোগ পোকা প্রতিরোধী মাধ্যম হিসাবে গড়ে ওঠে। একটি খামারের বিভিন্ন রসদের যথাযথ ব্যবহার, জৈব বৈচিত্র রক্ষা এবং গবাদি পশুর রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং কৃষিকে সুস্থায়ী করা যায়। জৈব কৃষিতে সর্বাধিক ফসল পাওয়ার লক্ষ্য থাকে না, বরং খামারের রসদগুলির যথাযোগ্য ব্যবহারের মাধ্যমে যতটা সম্ভব বেশি ফসল ফলানোর লক্ষ্য থাকে।

জৈব কৃষির ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়গুলি হলঃ

১) মাটিকে উদ্ভিদ খাদ্যে সমৃদ্ধ করা।

২) মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ।

৩) ভূমি ও বৃষ্টির জল সংরক্ষণ।

৪) সৌর শক্তির সর্বাধিক ব্যবহার।

৪) কৃষির উপকরণ তৈরিতে স্বনির্ভর হওয়া।

৬) বন্ধু পোকা-মাকড়ের সংরক্ষন এবং উপকারী জীবাণু ও পোকার ব্যবহার।

৭) ঘরোয়া গাছ-গাছড়ার মাধ্যমে শস্য সুরক্ষা।

৮) ফেরোমান ফাঁদ ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা।

মাটিকে উদ্ভিদ খাদ্যে সমৃদ্ধ করা

মাটিকে উদ্ভিদ খাদ্যে সমৃদ্ধ করতে হলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বন্ধ, ফসলের অবশিষ্টাংশ ক্ষেতে আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহার, জৈব ও জীবাণুসার ব্যবহার, ফসলের পর্যায়ক্রমিক চাষ, একাধিক ফসল চাষ, মাটির উপর সর্বদা সবুজ আচ্ছাদন বজায় রাখা, অত্যধিক কর্ষণ বন্ধ করা প্রভৃতি প্রয়োজন।

জৈব সারের উল্লেখযোগ্য উপকারী বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

(ক) খাদ্যপ্রাণ গুলি ধীরে ধীরে মুক্ত হয় ও গাছের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় আসে। ফলে, এই সার দীর্ঘদিন ধরে কার্যকরী থাকে,

(খ) মাটির ভৌত ধর্মের মান যেমন, গঠন, গ্রথন, জলধারণ ও বায়ুচলাচল ক্ষমতা ইত্যাদির উন্নতি ঘটায়,

(গ) মাটির প্রাণ ‘হিউমাস’ গঠন করে,

(ঘ) মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুগুলির বংশবৃদ্ধি করে,

(ঙ) জৈবসার হল প্রকৃতিগতভাবে সুষম সার এবং এতে প্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যগুণই অল্প বিস্তর বর্তমান থাকে,

(চ) কচুরীপানা, ধানের খড়, তুষ ইত্যাদি জৈব আচ্ছাদনের কাজ করে।

জৈব সারের বৈচিত্রও কম নয়। গোবর সার, খোল, কেঁচো সার, পোলট্রি সার, কম্পোস্ট সার, আবর্জনা সার, হাড় গুঁড়ো, শিং গুঁড়ো প্রভৃতির প্রয়োগ যথেষ্ট কার্যকরী ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

জৈব বস্তুর পুনরাবর্তন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন, ঘরোয়া অথচ অর্থবহ প্রযুক্তি। গবাদি পশুর মলমূত্র, ফসলের ফেলে দেওয়া বা অপ্রয়োজনীয় অবশেষ (crop residues), সবুজ লতা-পাতা, আগাছা ইত্যাদি খামারের সার বা কেঁচো সার রূপে ক্ষেতে প্রয়োগ করার প্রচলিত পদ্ধতিকে বিস্মৃত না হয়ে আরও পরিশীলিত, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করে প্রয়োগ করতে হবে।

জীবাণু সারের ব্যবহার জৈব কৃষি ক্ষেত্রে যুগান্ত সৃষ্টি করার শক্তি ধরে। উপযুক্ত পরিকাঠামো, উৎপাদন, উন্নত মানের জীবাণুসারের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ এবং উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে তেমনভাবে প্রসার লাভ না করলেও জীবাণুসারের উপকারিতা এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। শুধুমাত্র প্রয়োজন কৃষকের সচেতনতা বৃদ্ধি, সহজলভ্যতা আর উপযুক্ত গুণমানের সরবরাহ। তাহলেই কম খরচে, কম মেহনতে রাসায়নিক সারের একটা ভালো বিকল্প পাওয়া যাবে। জীবাণুসারের মধ্য দিয়ে।

সময়মতো নীল সবুজ শ্যাওলা ও অ্যাজোলা চাষ করে জমির মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে ভালো পরিমাণ উদ্ভিদ পুষ্টির সাথে সাথে জৈবসার যোগ করা যায়। তরল সার প্রয়োগ জৈব কৃষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সার সহজে গাছ গ্রহণ করতে পারে, উদ্ভিদ খাদ্য খুবই সহজলভ্য অবস্থায় পাওয়া যায়। তরলসারের সঙ্গে ফসলের অবশিষ্টাংশও মেশানো হয়। প্রতিটি ফসলে একর প্রতি ২০০ লিটার করে তরল সার ৩-৪ বার করে সেচ বা বৃষ্টির পরে পরে প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া, গরুর মূত্র ও ভার্মি ওয়াশ প্রতিটি ফসলে ২-৩ বার স্প্রে করা হয়। পরীক্ষিত এবং সুপারিশকৃত কয়েকটি তরল সার হল—

সঞ্জীবক : ২০ কেজি গোবর, ১০ লিটার গোমূত্র, ৫০০ গ্রাম ঝোলা গুড়, ৩০ লিটার জলে গুলে আবদ্ধ ড্রামে ১০ দিন পচানো হয়। তারপর ওই মিশ্রণ জল মিশিয়ে ২০ গুণ বৃদ্ধি করে মাটিতে বা সেচের সঙ্গে প্রয়োগ করা হয় এক একর জায়গাতে।

জীবাণুত : ১০ কেজি গোবর, ১০ লিটার গোমূত্র, ২ কেজি ঝোলা গুড়, ২ কেজি গমের ময়দা ও ২ কেজি জীবন্ত-বস্তু যুক্ত মাটি ২০০ লিটার জলে গুলে ৫-৭ দিন পচানো হয়। পচানোর সময় প্রত্যহ ৩ বার দ্রবণটিকে নাড়ানো হয়। ঐ মিশ্রণ সেচের জলের সঙ্গে মিশিয়ে এক একরে প্রয়োগ করা হয়। একটি ফসলে মোট ৩ বার প্রয়োগ করা উচিৎ। প্রথমবার বীজ বোনার আগে, দ্বিতীয় বার বীজ বোনার ২০ দিন পর এবং তৃতীয় তথা শেষ বার ৪৫ দিন পর।

পঞ্চগব্য: ৪ কেজি গোবর গোলা, ১ কেজি টাটকা গোবর, ৩ লিটার গো-মূত্র, ২ লিটার গোরুর দুধ, ২ লিটার দই, ১ কেজি মাখন অয়েল মিশিয়ে ৭ দিন আবদ্ধ পাত্রে পচানো হয়। প্রত্যহ ২ বার করে নাড়ানো হয়। ২০ লিটার পঞ্চগব্য জলে গুলে ৬৫০ লিটার মিশ্রণ ১ একরে স্প্রে করা হয়। বীজ শোধনের কাজেও এটি ব্যবহার করা যায়।

সমৃদ্ধ পঞ্চগব্য : ১ কেজি টাটকা গোবর, ৩ লিটার গোমূত্র, ২ লিটার গোরুর দুধ, ২ লিটার দই, কেজি দেশি ঘৃত, ৩ লিটার আখের রস, ৩ লিটার নারকেলের জল, ১২টি কলা একসঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে আবদ্ধ পাত্রে ৭ দিন পচানো হয়। ২০ লিটার এই মিশ্রণ ৬৫০ লিটার জলে গুলে ১ একর জমির মাটির ওপরে স্প্রে করে সেচ দেওয়া হয়।

পশ্চিমবঙ্গে কৃষির কিছু বৈশিষ্ট ও জৈব কৃষি প্রসারের অনুকূল অবস্থা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *