প্রবন্ধ রচনা সহজ উপায়

প্রবন্ধ রচনা

প্রবন্ধ বলতে বোঝায় কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে গদ্যের আকারে আলোচনা। ‘প্রবন্ধ’ যখন রচনা, তখন তা দুই প্রকারের হতে পারে– [১] বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ এবং [২] আত্মগত বা ভাবনিষ্ঠ প্রবন্ধ।

বিদ্যালয় স্তরে আমরা যে-ধরনের প্রবন্ধ লিখতে শিখি, আঙ্গিকের দিক থেকে সেগুলি তিন ভাগে বিভক্ত—[১] বর্ণনামূলক, [২] কাহিনিমূলক ও [৩] যুক্তিমূলক

প্রবন্ধ লিখনের জন্য পালনীয় নির্দেশ—

• প্রবন্ধের বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।

• প্রবন্ধের ভাষা সরল ও সাবলীল হওয়া প্রয়োজন।

• মূল প্রবন্ধ যাতে ‘ভূমিকা’, ‘বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন উপশিরোনাম’-এ এবং ‘উপসংহার’-এ বিভক্ত থাকে সে-বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

• যুক্তি ও পরিমিতিবোধ উৎকৃষ্ট প্রবন্ধের দুটি মহৎ গুণ | তাই এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।

• বাক্যের গঠন, বিরাম চিহ্নের ব্যবহার প্রসঙ্গে সতর্ক হওয়া কাম্য।

• প্রয়োজনে প্রবন্ধের যে-কোনো জায়গায় প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে।

• পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নির্দেশ অনুসারে প্রতিটি প্রবন্ধের জন্য বরাদ্দ শব্দসংখ্যা কমবেশি ৪০০ | শব্দসীমা বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।


বিজ্ঞান ও পরিবেশ

প্রবন্ধ ১ | মোবাইল ফোন

ভূমিকা:বিজ্ঞানের যে কটি বিস্ময়কর আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে আরও আধুনিক ও আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে, মোবাইল আজকের , ফোন সেগুলির অন্যতম। মোবাইল ফোন আধুনিক গতিশীল পৃথিবীর অপরিহার্য অঙ্গ, জীবনের দ্রুত চলমানতার সঙ্গে মানানসই এক অতি আবশ্যিক উপকরণ।

মোবাইল ফোনের ইতিহাস

১৯৪৬ সালে আমেরিকায় যে মোবাইল টেলিফোন ব্যবস্থা চালু হয়েছিল তাকেই মোবাইল ফোনের আদিরূপ বলা হয়। বেল সিস্টেম মোবাইল টেলিফোন সার্ভিস নামে প্রচলিত এই সংযোগ ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হওয়ায় বিশেষ জনপ্রিয় হয়নি। এরপর কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে ১৯৭৩ সালে ড. মার্টিন কুপার আধুনিক মোবাইল ফোনকে পৃথিবীর মানুষের কাছে হাজির করেন। সেই আদি মোবাইলটির ওজন ছিল ২ কিলোগ্রাম। ১৯৭৯ সালে জাপান প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সেলুলার নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা চালু করে। ১৯৯০ সালে সমগ্র পৃথিবীতে ১ কোটি ২৪ লক্ষমানুষ মোবাইল ব্যবহার করতেন। কিন্তু অতি দ্রুত এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১০ সালে বিশ্বজুড়ে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৬ কোটি | ভারতে ১৯৯৫ সালে মোবাইল ফোনের পরিসেবা বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়। ২০১৪ সালে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা হয়েছে ৪.৫৫ বিলিয়ন | ভারতের মতো দেশের ক্রমবর্ধমান বাজারের কথা মাথায় রেখে দেশীয় এবং বহুজাতিক অনেক সংস্থাই যেমন, বিএসএনএল, ভোডাফোন, এয়ারটেল, এয়ারসেল, টাটা, আইডিয়া সেলুলার প্রভৃতি এদেশে মোবাইল পরিসেবা দিতে উদ্যোগী হয়েছে।

মোবাইল ফোনের উপযোগিতা

বর্তমানে মোবাইল ফোন এমন একটি বৈদ্যুতিন উপকরণ যার উপযোগিতা আধুনিক জীবনে সর্বত্র | চিঠি লেখার ও পাওয়ার অপেক্ষা এবং অনিশ্চয়তাকে দূর করে মোবাইল নিয়ে এসেছে এসএমএস পরিসেবা। সংযোগকে আরও প্রাণবন্ত করেছে এই ব্যবস্থা। কম্পিউটারের দুনিয়াকেও অনেকটাই হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে মোবাইল ফোন। ই-মেল, ইনটারনেট—এইসব পরিসেবাই এখন মোবাইল ফোনের কারণে সহজে উপলব্ধ। ব্লুটুথ বা ইনফ্রারেড প্রযুক্তি সংযোগব্যবস্থাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। স্থির এবং চলমান ফোটোগ্রাফিও অনায়াসে সম্ভব এই মোবাইল ফোনের সাহায্যে। মোবাইলে রয়েছে বিনোদনের অজস্র ব্যবস্থা। রেডিয়ো, এমপিথ্রি, গেমিং, এমনকি টিভির অনুষ্ঠানও মোবাইলের সাহায্যে উপভোগ করা সম্ভব। মোবাইলে প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমশই উন্নত হচ্ছে। মোবাইল ব্যবস্থা এখন চতুর্থ প্রজন্মে প্রবেশ করেছে। মোবাইলের মাধ্যমে টাকাপয়সার লেনদেনের ক্ষেত্রে নেট-ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে যেমন কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি আগামী দিনে এটি ক্রেডিট কার্ডের বিকল্প হিসেবেও ব্যবহৃত হতে চলেছে । এইভাবে মোবাইল ফোন যেন আলাদিনের মায়ার প্রদীপের মতো জাদুকরি শক্তির অধিকারী।

মোবাইল ফোনের খারাপ দিক

বিজ্ঞানের যে-কোনো আবিষ্কারের মতোই মোবাইলেরও কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে | কিশোরমনে মোবাইল ফোনের প্রতি যে আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে তা এক নেতিবাচক সামাজিক চাহিদার জন্ম দিচ্ছে। মোবাইলের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বিদ্যালয়ের পরিবেশকে নষ্ট করে দিচ্ছে, আবার ছাত্রছাত্রীদের মনঃসংযোগেও ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। নানারকম সামাজিক দূষণও এর মাধ্যমে ঘটছে। নাগরিক জীবনে মোবাইলের অসতর্ক ব্যবহার যেমন গাড়ি চালানো কিংবা রাস্তা পারাপার বা লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার সময়ে মোবাইল ফোনের ব্যবহার দুর্ঘটনা ডেকে আনছে। মোবাইলের অতিরিক্ত ব্যবহার প্রবণেন্দ্রিয় ও হার্টের সমস্যা তৈরি করতে পারে এরকম কথাও অনেকে বলেন, কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনও এমন ধারণাকে সমর্থন করেনি। সবমিলিয়ে মোবাইল ফোনের যথাযথ ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজন। বিদ্যালয় স্তরে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক।

উপসংহার: বিজ্ঞানের যে-কোনো যুগান্তকারী আবিষ্কারের মতোই মোবাইলের সার্থকতা নির্ভর করছে তার ব্যবহারের উপর। নাগরিক সচেতনতা এই আধুনিক উপকরণটির প্রয়োগকে তাই সার্থক করে তুলতে পারে| গতিশীল আধুনিক যুগের ট্রেডমার্ক মোবাইল ফোনকে বাদ দিয়ে একুশ শতককে ভাবা অসম্ভব।


প্রবন্ধ ২ | বিশ্ব-উন্নায়ন

 “উন্মুক্ত বন্দর সব নীল সমুদ্রেরপায়ে পায়ে মানুষ ও মেশিনের যৌথ শক্তিবলে নীলিমাকে আটকেছে ইঁদুরের কলে।”

—জীবনানন্দ দাশ

ভূমিকা: একুশ শতকে বিজ্ঞানের আলোকিত উপস্থাপনা যেমন মানব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ, ভারসাম্যহীন উন্নয়ন নিয়ে এসেছে আশঙ্কার কালো মেঘ। বিশ্ব-উন্নায়ন, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Global Warming এরকমই একটি আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করার বিষয়।

বিশ্ব-উন্নায়ন কী?

আপাতভাবে বিশ্ব-উন্নায়ন কথাটির অর্থ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি। ১৮৯৬ সালে নোবেলজয়ী সুইডিশ বিজ্ঞানী আরথেনিয়াস বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তাঁর আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণিত করে ১৮৫০ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস | বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নতা বৃদ্ধির এই হার হবে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফল মানবসভ্যতার পক্ষে হবে সর্বনাশের।

বিশ্ব-উন্নায়ন ও গ্রিনহাউস গ্যাস

বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসসমূহ যেমন— কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কোরোফ্লুরোকার্বন, জলীয় বাষ্প ইত্যাদির বৃদ্ধি তাপীয় ভারসাম্যকে বিনষ্ট করে দিচ্ছে। শিল্পবিপ্লবের আগে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ ছিল ২৮০ পিপিএম, ২০০৭ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮২ পিপিএম। একইভাবে বছরে গড়ে ৪৪০-৬০০ মিলিয়ন টন মিথেন বায়ুমণ্ডলে এসে মিশছে। গ্রিনহাউস এফেক্টে এই মিথেনের অবদান প্রায় ১৩ শতাংশ।

মানুষের দায়িত্ব: পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি তথা গ্রিনহাউস এফেক্ট তৈরিতে মানুষেরই ভূমিকা প্রধানতম। নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করা, কাঠ এবং জীবাশ্মকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা, সিমেন্ট শিল্পের প্রসার ইত্যাদি বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের বৃদ্ধি ঘটায়। এ ছাড়া সার শিল্প, অ্যালুমিনিয়াম শিল্প, এয়ারকন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটর শিল্প ইত্যাদি বাতাসে নানারকম গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে।

প্রভাব; গ্রিনহাউস এফেক্ট এবং বিশ্ব-উন্নায়নের ফলে বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। ১৯৯৯ সাল গত দুশো বছরে উন্নতম বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, এই তাপীয় অবস্থা বজায় থেকেছে পরবর্তী সময়েও। খরা, বন্যা, তুষারঝড় ইত্যাদি নানান বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ২০০৪ সালে । এক মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫৬২ টি টর্নেডো সৃষ্টি হয়েছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। গত ৩০ বছরে সুমেরুর বরফ গলেছে ৩৮,০০০ বর্গকিমি | এর ফলে = সমুদ্রের জলের উচ্চতা বেড়ে চলেছে বর্তমানে প্রতিবছর ৩.১ মিলিমিটার হারে । ফলে এক বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী ভূখণ্ড চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রহর গুনছে। ডেঙ্গু, এনকেফেলাইটিস, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি। অসুখের প্রাদুর্ভাব ঘটছে বিশ্ব-উম্নায়নের ফলে—এমনটাই জানিয়েছেন হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের চিকিৎসকরা | জীবকুলের অস্তিত্বও বিপন্ন হচ্ছে। বরফ গলে যাওয়ায় পেঙ্গুইন, মেরুভল্লুক ইত্যাদি প্রাণীরা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে।

প্রতিরোধের প্রয়াস

গ্রিনহাউস গ্যাস বেরোনো বন্ধ করতে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনেরোতে বসেছিল বসুন্ধরা শীর্ষসম্মেলন। পরবর্তীকালে ২০০২-এ জোহেনসবার্গে, ২০০৫-এ জাপানের কিয়োটো শহরে এবং ২০০৭-এ ইন্দোনেশিয়ার বালিতে একই উদ্দেশ্যে সম্মেলন হয়। কিন্তু এই বিপর্যয়ের জন্য যে উন্নত দেশগুলি প্রধানত দায়ী তাদের অসহযোগিতায় কোনো সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। তাই আশঙ্কার কালো মেঘে ঢাকা পড়ে আছে একুশ শতকের বিজ্ঞানপ্রদীপ্ত মানবসভ্যতা।