(উত্তর) ভূমিকা : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের অভ্যুত্থান সিপাহিদের দ্বারা সূচিত হলেও এই বিদ্রোহ শুধু সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।
জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ
(১) দিল্লি, লখনউ, অযোধ্যা প্রভৃতি অঞ্চলে জনগণ তাদের বল্লম, টাঙ্গি, ছুরি, দা, কাস্তে প্রভৃতি নিয়ে বিদ্রোহী সিপাহিদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং কোম্পানির অনুগত সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
(২) দিল্লি, অযোধ্যা, কানপুর, লখনউ সমেত প্রায় গোটা উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাস্তাঘাট নষ্ট করে কোম্পানির সেনাবাহিনীর রসদপত্র সরবরাহের কাজে বাধা দেওয়া হয়।
(৩) গ্রামাঞ্চলে সুদখোর মহাজন ও নতুন জমিদারদের বাড়িঘর ও কাছাারি লুঠ করা হয়।
মহাবিদ্রোহে জনগণের পরোক্ষ অংশগ্রহণ
(১) স্থানীয় ভৃত্য, পরিচায়ক ও আয়ারা তাদের কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে ইংরেজদের বিপদে ফেলেছিল।
(২) বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণ ইংরেজদের কাছে বিদ্রোহী সিপাহিদের গতিবিধি সম্পর্কে খবরাখবর গোপন রাখত এবং উপজাতি অঞ্চলের পুরুষ ও মহিলারা নানাভাবে বিদ্রোহীদের সাহায্য করত।
উপসংহার
এভাবে দেখা যায় যে, বিদ্রোহী সিপাহিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জনগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিদ্রোহে শামিল হয়ে বিদ্রোহের চরিত্রকেই বদলে দিয়েছিল।
টীকা লেখো : মহাবিদ্রোহের সময় হিন্দু-মুসলিম ঐক্য।
উত্তর :- ভূমিকা : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের সময় হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এই মহাবিদ্রোহ-আগেকার বিদ্রোহগুলি থেকে ভিন্ন মাত্রার মর্যাদা পেয়েছে। নরহরি কবিরাজের মতে, “বিদ্রোহের সময় হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ছিল চোখে পড়ার মতো।”
হিন্দু-মুসলিম ঐক্য
মহাবিদ্রোহের সময় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল—
1. হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক
এই বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে নেতা বলে মেনে নেয়। তিনি ছিলেন উভয় সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রতীক এবং মিলিত আন্দোলনের প্রেরণা।
2. গো-হত্যার নিষেধ
বিদ্রোহে যেসব অঞ্চল কোম্পানির কবলমুক্ত হয়েছিল, সেইসব অঞ্চলে বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতেও বাহাদুর শাহ হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রতীক হিসেবে জাফর কোরবানি বা গো-হত্যা নিষেধ করে দেন।
3. নেতৃবর্গ
ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই, তাঁতিয়া টোপির মতো হিন্দু নেতৃত্বের পাশাপাশি দিল্লিতে বরকত খাঁ, বেরিলিতে খান বাহাদুর, গোরক্ষপুরে মোহম্মদ হাসান, অযোধ্যায় বেগম সাহেবা, ফৈজাবাদে আহম্মদুল্লাহ প্রমুখ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
পর্যালোচনা
সম্প্রতি ব্রিটিশ লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পিল তাঁর ‘The Last Mughal’ গ্রন্থে মহাবিদ্রোহে মুসলিমদের ধর্মীয় আবেগের ওপর জোর দিলেও নানান ক্ষেত্রে উভয় সম্প্রদায়ের ঐক্য দেখে ইংরেজরা হতবাক হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এচিসন বলেছেন, “এই বিদ্রোহের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছিল।”
মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি বা স্বরূপ কেমন ছিল?
উত্তর) ভূমিকা : মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি বা স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিকগণ সাধারণত যেসব মত প্রকাশ করে থাকেন, সেগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- (১) সিপাহি বিদ্রোহ, (২) জাতীয় বিদ্রোহ, (৩) ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং (৪) সামন্ততান্তিক প্রতিক্রিয়া।
সিপাহি বিদ্রোহ
ম্যালেসন, জন কে, স্যার জন লরেন্স, রবার্টস প্রমুখ ইংরেজ ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ বলে মনে করলেও সমসাময়িক ভারতীয় স্যার সৈয়দ আহম্মদ খাঁ, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এই বিদ্রোহকে সিপাহি ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত বিদ্রোহ বলে মনে করেছেন। তবে মুজফ্ফরপুর, সাহারণপুর, বান্দা, ফরাক্কাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলের জনগণই প্রথম বিদ্রোহ শুরু করে সিপাহিদের যোগদানে বাধ্য করে।
জাতীয় বিদ্রোহ
১৮৫৭-র বিদ্রোহের স্পষ্ট উদ্দেশ্য ও সর্বভারতীয় চরিত্র না-থাকলেও উত্তর ও মধ্য ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নানা শ্রেণির জনগণ ও সিপাহিরা একযোগে লড়ে ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদ ঘটানোর জন্য নিজেদের মনোনীত দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে। তাই ঐতিহাসিক জে বি নর্টন, আলেকজান্ডার ডাফ, হোমস্ প্রমুখ দেখিয়েছেন, প্রথমে সিপাহিদের দ্বারা বিদ্রোহ শুরু হলেও পরবর্তীকালে তা আর সিপাহিদের মধ্যেই। সীমাবদ্ধ ছিল না, জাতীয় রূপ ধারণ করেছিল।
ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম
ইংরেজ-বিরোধী এত ব্যাপক আন্দোলন ভারতে ইতিপূর্বে আর ঘটেনি বলে প্রখ্যাত বিপ্লবী বিনায়ক দামোদর সাভারকর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে ভারতের ‘প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে অভিনন্দিত করেছেন।
সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া
কিছু রাজ্যচ্যুত সামন্ত রাজা ও ভূমিচ্যুত জমিদার, তালুকদার এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ায় বামপন্থী চিন্তাবিদ রজনীপাম দত্ত এই বিদ্রোহকে রক্ষণশীল ও সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলির অভ্যুত্থান বলে উল্লেখ করেছেন।
উপসংহার
১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহকে ‘ক্ষয়িষ্ণু’ অভিজাত শ্রেণির মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’ বলে অভিহিত করে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের তথাকথিত জাতীয় স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ না ছিল প্রথম, না ছিল জাতীয়, না ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ” (“The so-called First National War of Independence in 1857 is neither First, nor National, nor a War of
Independence”)।