পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ বিভিন্ন কারণে সামুদ্রিক অভিযান বা ভৌগোলিক আবিষ্কারে অংশগ্রহণ করেছিল। সমকালীন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, বাণিজ্যের বিকাশ, প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি, নৌ-চলাচল বিদ্যার অগ্রগতি, ধর্মীয় প্রেরণা, দুঃসাহসী নাবিকদের অদম্য ইচ্ছা প্রভৃতি ঘটনা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক আবিষ্কারে অংশগ্রহণের নেপথ্যে কাজ করেছিল।
অভ্যন্তরীণ সুস্থিতি ও রাজকীয় সহায়তা
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে পোর্তুগালে শান্তি ও সুস্থিতির পরিবেশ বিরাজ করায় পোর্তুগাল নিশ্চিন্তে ভৌগোলিক অভিযানের দিকে মনোনিবেশ করতে পেরেছিল। তা ছাড়াও কোনো কোনো দেশের শাসকরা ভৌগোলিক আবিষ্কারের বিষয়ে বিশেষভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় অভিযানের কাজটি সহজতর হয়েছিল। স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ এবং রানি ইসাবেলা ভৌগোলিক অভিযানে সেদেশের নাবিকদের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা
পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে কৃষি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন রপ্তানি পণ্য উৎপাদন শুরু হয়েছিল। এইসব পণ্য ইউরোপের বাইরে রপ্তানি এবং ইউরোপের বাইরের বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে ইউরোপের বিভিন্ন নতুন নতুন দেশে বাজারের সন্ধানের জন্য সামুদ্রিক অভিযানে নেমে পড়েছিল। তা ছাড়া পোর্তুগালের সোনার জোগান কমে গেলে তারা নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রয়োজনে সামুদ্রিক অভিযানে অংশ নিয়েছিল।
নতুন বাণিজ্যপথের সন্ধান
পঞ্চদশ শতকের পূর্বে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বাণিজ্যিক ও অন্যান্য যোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ভেনিস ও জেনোয়া। কিন্তু ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি মুসলিমদের আক্রমণে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ঘটলে ইউরোপীয় বণিকরা প্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমধ্যসাগরীয় পথটি ব্যবহারের সুযোগ হারায়। এর ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ প্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে নতুন কোনো পথের সন্ধানে সচেষ্ট হয়।
ভ্রমণকাহিনি
পঞ্চদশ শতকে নবজাগরণের প্রভাবে ইউরোপে বিভিন্ন ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত হয়। ফলে বিশ্বের দূরবর্তী অঞ্চলগুলি সম্পর্কে ইউরোপের মানুষের মধ্যে আগ্রহের সঞ্চার ঘটে। মার্কোপোলো, জরদ্যা, জুরারা প্রমুখের ভ্রমণকাহিনি বিশ্বের বিভিন্ন দূরবর্তী স্থান সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়। জানার বাইরে কোন্ অজানা জগৎ আছে তা জানতে ইউরোপের মানুষ আকুল হয়ে ওঠে।
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার
দ্বাদশ শতকের কম্পাসের আবিষ্কার সামুদ্রিক অভিযানে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিল। পরবর্তীকালে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের জন্য অ্যাস্ট্রোল্যাব যন্ত্রের আবিষ্কার, উন্নত মানচিত্রের প্রকাশ প্রভৃতি নাবিকদের ভৌগোলিক অভিযানকে আরও সহজ করে দেয়। গ্যালিলিয়ো গ্যালিলেই বলেন যে পৃথিবী গোলাকার। এই তথ্য নাবিকদের সাহস জোগায় যে, অজানা সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই। বহু দূরে চলে গেলেও বৃত্তাকার পথ ধরে তাদের জাহাজ আবার স্বদেশে ফিরে আসবে।
চার্চের উৎসাহদান
তুর্কি মুসলিমদের আক্রমণে। কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন (১৪৫৩ খ্রি.) ঘটলে ইসলামের অনুপ্রবেশে ইউরোপের খ্রিস্টানধর্ম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। হয়। ইসলামের প্রসার প্রতিহত করে খ্রিস্টানধর্মের প্রসার ঘটানোর তাগিদ শুরু হয়ে যায়। এজন্য দূর সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে খ্রিস্টানধর্মের প্রসার ঘটানোর জন্য খ্রিস্টান চার্চও সামুদ্রিক অভিযানে উৎসাহ দেয়।
জনসংখ্যা হ্রাস
চতুর্দশ শতকে ইউরোপে প্লেগের প্রাদুর্ভাবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হলে সেখানকার জনসংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে কমে যায়। এতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়। জনসংখ্যার ঘাটতি পূরণ করে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে স্পেন, পোর্তুগাল, হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ সামুদ্রিক অভিযানে অংশ নেয়। তারা অভিযানের মাধ্যমে দূরবর্তী বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রীতদাস আমদানি করে অর্থনৈতিক অগ্রগতির উদ্যোগ নেয়।
মহিমা প্রচার
পঞ্চদশ শতকের ভৌগোলিক আবিষ্কারের কাহিনি ছিল বহু দুঃসাহসী নাবিক ও অভিযাত্রীদের বীরত্বের কাহিনি। এই সকল নাবিক ও অভিযাত্রীরা নিজেদের ব্যক্তিগত বীরত্ব ও জাতীয় গৌরব বিশ্ববাসীর সম্মুখে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে অজানা সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল।