অশোক ধর্মপ্রচারকে রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সংযুক্ত করে রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধি করেছিলেন।
1. সুমহান আদর্শ
ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে তিনি প্রাচীন কালে যে সুমহান আদর্শের স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা বিশ্ব-ইতিহাসে বিরল ঘটনাগুলির মধ্যে বিরলতম। রাজপদের ভোগবিলাস ত্যাগ করে তিনি জনকল্যাণ, অহিংসা ও শান্তির বাণী প্রচারের জন্য কাজ করে গেছেন।
2. পরধর্মসহিষ্বতা
তিনি নিজে বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী হলেও অন্য ধর্মের প্রতি তাঁর আন্তরিক সহানুভূতি ছিল। তিনি তাঁর প্রজাদের নিজ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ এবং পরধর্মকে নিকৃষ্ট না ভাবার উপদেশ দেন।
3. বিশ্ব-ইতিহাসে স্থান
অশোকের মধ্যে উদারতা লক্ষ করে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, বিশ্বের ইতিহাসে অশোক অতুলনীয়, অশোকের আবির্ভাব ভারতকে মহিমান্বিত করেছে। বিশ্বের উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন সম্রাট যেমন, আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার, কনস্টানটাইন, শার্লামেন, আকবর, নেপোলিয়ন প্রমুখের চেয়েও অশোক শ্রেষ্ঠতম বলে বিভিন্ন ইতিহাসবিদ অভিমত দিয়েছেন। ইতিহাসবিদ এইচ. জি. ওয়েলস বলেছেন যে, ইতিহাসের পাতায় হাজার হাজার নরপতির মধ্যে একমাত্র অশোক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। তিনি আজও ভল্গা থেকে জাপান পর্যন্ত স্মরণীয়।
অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’-এর স্বরূপ
প্রকৃত বৌদ্ধধর্ম ও অশোকের প্রচারিত ‘ধৰ্ম্ম’ অভিন্ন ছিল কি না তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।
1. বৌদ্ধধর্ম ও অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ অভিন্ন—অভিমত :
ড. ভাণ্ডারকর, ড. বেণীমাধব বড়ুয়া, ড. সেনার্ট প্রমুখ বৌদ্ধধর্ম ও অশোকের প্রচারিত ‘ধৰ্ম্ম’-কে সম্পূর্ণ অভিন্ন বলে উল্লেখ করে উভয়ের মধ্যে বিভিন্ন সাদৃশ্য ও ঘনিষ্ঠতা তুলে ধরেছেন।
1. ড. ভাণ্ডারকরের অভিমত
ড. ভাণ্ডারকর বলেছেন, বৌদ্ধধর্মে দুটি অনুশাসন ছিল—
[i] বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি এবং [ii] গৃহী ভক্তদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি। ভগবান বুদ্ধ নিজেই বৌদ্ধধর্মের কঠোর অনুশাসনগুলি ছেড়ে গৃহীদের জন্য নমনীয় অনুশাসন ঠিক করে দেন। অশোক ও তাঁর প্রজারা গৃহী ছিলেন। তাই অশোক তাঁর লেখগুলিতে দ্বিতীয় ধরনের অর্থাৎ গৃহীদের জন্য পালনীয় আচরণবিধিগুলির প্রচার করেন। গৃহী উপাসকদের পাঠ্য বৌদ্ধ ধর্মপুস্তক দীঘনিকায়ের সিগালবাদ সুত্ত’ বা ‘গিহি বিনয়’-এর উপদেশগুলি ও অশোকের প্রচারিত ধর্মীয় বাণীগুলি একই ধরনের। এজন্য ড. ভাণ্ডারকরের মতে, বৌদ্ধধর্ম ও অশোকের প্রচারিত ‘ধৰ্ম্ম’ ছিল সমার্থক।
2. অন্যান্যদের অভিমত
কেউ কেউ মনে করেন যে, বৌদ্ধ ধৰ্ম্মপাদের নীতিগুলির সঙ্গে অশোকের ‘ধম্ম’-এর নীতিগুলির বহু সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। অশোক তাঁর একাদশ শিলালিপিতে ‘সকল দান অপেক্ষা ধৰ্ম্ম দান শ্রেষ্ঠ’ বলে উল্লেখ করেছেন। বৌদ্ধ ধম্মপাদেও অনুরূপ কথা বলা হয়েছে। আবার অশোক যেমন তাঁর ‘ধৰ্ম্ম’-এ অহিংসা ও প্রাণীহত্যা না করার ওপর জোর দিয়েছেন, তেমনি বৌদ্ধ ধৰ্ম্মপাদেও এবিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। এজন্য ড. বেণীমাধব বড়ুয়া অশোকের প্রচারিত ‘ধৰ্ম্ম’কে ‘সংস্কারিত বৌদ্ধধর্ম’ বলে উল্লেখ করেছেন।
2. বৌদ্ধধর্ম ও অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ ভিন্ন—অভিমত
ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, রিস ডেভিডস, ক্লিট প্রমুখ ড.. ভাণ্ডারকরের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, অশোকের প্রচারিত ‘ধম্ম’-এর সঙ্গে তাঁর নিজের পালন করা বৌদ্ধধর্মের বহু পার্থক্য রয়েছে।
1. বৌদ্ধধর্মের মূলনীতি অনুপস্থিত
বৌদ্ধধর্মের বেশ কিছু অনুশাসন অশোকের ‘ধম্ম’-এ অনুপস্থিত। বৌদ্ধধর্মের মূলনীতিগুলি যেমন—আর্যসত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ, কার্যকারণ সম্পর্ক, নির্বাণ প্রভৃতির কোনো উল্লেখ অশোকের প্রচারিত ‘ধর্ম্ম’ এ নেই।
2. বৌদ্ধধর্ম-বহির্ভূত রীতিনীতি
বৌদ্ধধর্মের অনুশাসন-বহির্ভূত কিছু রীতিনীতির অস্তিত্ব অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’-এ লক্ষ করা যায়। যেমন—বৌদ্ধ ধৰ্ম্মপাদে নির্বাণের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু অশোক তাঁর ‘ধৰ্ম্ম’-এ গৃহীদের জন্য স্বর্গের কথা বলেছেন।
3. বৌদ্ধ সংঘের সঙ্গে সম্পর্ক
অশোক তাঁর প্রচারিত ‘ধৰ্ম্ম’-এ বৌদ্ধধর্মের আচার-অনুষ্ঠানগুলি পালনের বা বৌদ্ধ সংঘের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়ে জোর দেননি।
4. বুদ্ধ, ধৰ্ম্ম ও সংঘ
অশোক নিজে ‘বুদ্ধ, ধৰ্ম্ম ও সংঘ’-এর প্রতি আনুগত্য জানালেও তিনি ‘ধৰ্ম্ম’-এর প্রচারে ‘বুদ্ধ, ধৰ্ম্ম ও সংঘ’-এর প্রতি প্রজাদের আনুগত্য জানানোর কথা বলেননি। এমনকি অশোক তাঁর প্রচারিত ধর্মকে ‘বৌদ্ধধৰ্ম’ বলে উল্লেখ না করে একে ‘ধৰ্ম্ম’ বলে উল্লেখ করেছেন।
অশোকের ধন্মের মূল্যায়ন
ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. ভিনসেন্ট স্মিথ, ড. রোমিলা থাপার, ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ অশোকের প্রচারিত ‘ধৰ্ম্ম’কে বৌদ্ধধর্ম থেকে পৃথক বলে মনে করেন।
1 নৈতিক অনুশাসন
তাঁদের মতে, অশোকের প্রচারিত ‘ধন্ম’ হল কতগুলি নৈতিক বিধানের সমন্বয়। কোনো বিশেষ ধর্মের সঙ্গে অশোকের ‘ধর্ম্ম’-এর সম্পর্ক নেই। হিন্দু ও বৌদ্ধ আদর্শের সমন্বয়ে অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ এর মূলনীতিগুলি গঠিত হয়েছিল। ‘ধৰ্ম্ম’ প্রচারের মাধ্যমে অশোক দেশে এমন একটি পরিমণ্ডল তৈরি করতে চেয়েছিলেন যেখানে সব সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে বসবাস করতে পারবে। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারও মনে করেন যে, অশোকের প্রচারিত ধর্ম ছিল আসলে কতগুলি নৈতিক অনুশাসন।
2. বিভিন্ন ধর্মের মূলনীতি
ড. ভিনসেন্ট স্মিথ মনে করেন যে, অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ হল কোনো বিশেষ ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন সকল ভারতীয় ধর্মের মূলনীতিগুলির সমন্বয়। বনগার্ড লেভিন মনে করেন যে, সকল ধর্মের অন্তর্গত মূলনীতিবোধের সারমর্মকেই অশোক ‘ধৰ্ম্ম’ বলে প্রচার করেছেন। ইতিহাসবিদ রিস ডেভিডসের মতে, অশোকের ‘ধর্ম্ম’ প্রচলিত অর্থে কোনো ধর্ম ছিল না। প্রকৃত জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের যা যা করা উচিত, অশোক ‘ধৰ্ম্ম’-এ সে কথাই বলেছেন।
3. নিজস্ব উদ্ভাবন
ড. রোমিলা থাপার মনে করেন যে, অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ কখনোই বৌদ্ধধর্ম নয়। ‘ধৰ্ম্ম’ ছিল অশোকের নিজস্ব উদ্ভাবন। তাঁর মতে, শান্তিবাদী আদর্শের প্রতি অনুরাগে নয়, রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতির প্রয়োজনেই তিনি ‘ধৰ্ম্ম’-এর প্রচার করেন।