ভারত : অশোক এবং ধম্ম

বহু ভাষা ও বহু ধর্মের দেশ ভারতে ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিভিন্ন শাসক ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে সম্রাটদের লক্ষ্য ছিল দেশের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা, ধর্মকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বশক্তিবৃদ্ধি করা। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতে যে সকল সম্রাট রাষ্ট্রপরিচালনা বা রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ধর্মকে সুকৌশলে ব্যবহার করেছেন এবং সাফল্য পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রাচীন যুগের মৌর্য বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক, মধ্যযুগের খলজি বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান আলাউদ্দিন খলজি এবং মোগল বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট আকবর।

অশোক ও কলিঙ্গ যুদ্ধ

প্রাচীন যুগে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে ষোড়শ মহাজনপদ নামে যে ষোলোটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল বর্তমান বিহারের অংশবিশেষে অবস্থিত মহাজনপদ মগধ। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নামে জনৈক ব্যক্তি ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মগধের সিংহাসনে বসে মৌর্য বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন সম্রাট অশোক। তিনি ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসনে বসেন।

1. কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা

সিংহাসন লাভের ত্রয়োদশ বর্ষে (২৬১-২৬০ খ্রি.পূ.) তিনি বর্তমান ওড়িশা ও অন্ধ্রের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। কলিঙ্গ যুদ্ধে এক লক্ষ মানুষ নিহত হয়, দেড় লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয় এবং বহু মানুষ নানাভাবে সীমাহীন দুঃখকষ্ট ভোগ করে। যুদ্ধে জয়লাভ করে অশোক কলিঙ্গকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের পঞ্চম প্রদেশ কলিঙ্গের রাজধানী হয় তোষালী।

2 অনুশোচনা:

কলিঙ্গ রাজা অশোকের সাম্রাজ্যভুক্ত হলেও কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁর মনে গভীর অনুশোচনার সৃষ্টি করে। অশোক তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় অপ্রধান শিলালিপিতে স্বীকার করেছেন যে, কলিঙ্গ যুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসলীলা তাঁর মনে পরিবর্তন আনে এবং তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।

অশোক ও বৌদ্ধধর্ম

বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে অশোকের ভূমিকা

1. বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ: সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পর বৌদ্ধভিক্ষু উপগুপ্তের কাছ থেকে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে দেশবিদেশের নানা প্রান্তে এই ধর্মের প্রচার শুরু করেন।

WhatsApp Channel Join Now
Telegram Channel Join Now

2 বাণী খোদাহ: অশোক তাঁর শিলালিপিতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে গৌতম বুদ্ধের অহিংসার বাণী প্রচার করেছেন। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য তিনি বিভিন্ন পাহাড় ও স্তম্ভের গায়ে বুদ্ধের বাণী খোদাই করেছেন। অশোক তাঁর অষ্টম শিলালিপিতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ‘বিহারযাত্রার পরিবর্তে ‘ধর্ম্মযাত্রা’র প্রবর্তন করেছেন।

3 অনুরাগ ও আনুগত্য: সাঁচি, সারনাথ, এলাহাবাদ প্রভৃতি শিলালিপি থেকে আশ্রমিক বৌদ্ধধর্মের প্রতি অশোকের অনুরাগের কথা জানা যায়। এ ছাড়া বৈরাট, ভাবরু প্রভৃতি শিলালিপি থেকে ‘বুদ্ধ, ধৰ্ম্ম ও সংঘ’-এর প্রতি অশোকের আনুগত্যের কথা জানা যায়।

ধম্ম ও তার প্রচার কর্মসূচি

সম্রাট অশোক ব্যক্তিগত জীবনে বৌদ্ধধর্মের অনুশাসনগুলি সম্পূর্ণ পালন করলেও তাঁর প্রচারিত ধর্মকে তিনি কখনোই বৌদ্ধধর্ম বলে উল্লেখ করেননি। বৌদ্ধধর্মের সকল কঠিন অনুশাসনগুলি সাধারণ মানুষের পক্ষে সর্বদা পালন করা সম্ভব নয় বলে অশোক তাদের জন্য ধর্মীয় অনুশাসনগুলিকে কিছুটা সহজসরল করে প্রচার করেন। তিনি তাঁর প্রচারিত ধর্মকে ‘ধৰ্ম্ম’ (Dhamma) বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি মাস্কি লিপিতে সর্বপ্রথম ‘ধৰ্ম্ম’ কথাটি ব্যবহার করেন। অশোকের প্রচারিত ‘ধৰ্ম্ম’ ছিল সহজসরল এবং জটিল দার্শনিক তত্ত্বমুক্ত। তিনি তাঁর ‘ধৰ্ম্ম’ প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল

বিভিন্ন দেশে অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ প্রচার
বিভিন্ন দেশে অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ প্রচার

1. ‘ধৰ্ম্ম’ প্রচারের উদ্যোগ এবং 2 জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি।

1. ধৰ্ম্ম প্রচারের উদ্যোগ

অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর থেকে দেশবিদেশের বিভিন্ন স্থানে এই ধর্ম প্রচারের উদ্যোগ নেন।

1. ধৰ্ম্মযাত্রা

তিনি বিহারযাত্রা’র পরিবর্তে ‘ধৰ্ম্মযাত্রা’ শুরু করেন এবং বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন তীর্থস্থানগুলি ভ্রমণ করেন। তিনি জানিয়েছেন, উপাসকত্ব গ্রহণ করে বুদ্ধের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তীর্থক্ষেত্রগুলি তিনি ভ্রমণ করেছেন।

2. কর্মচারী নিয়োগ

ধৰ্ম্ম প্রচার করার উদ্দেশ্যে অশোক রাজুক, যুক্ত, পুরুষ, প্রাদেশিক প্রভৃতি কর্মচারী নিয়োগ করেন। প্রতি তিন বা পাঁচ বছর পরপর সাম্রাজ্য পরিভ্রমণ করে তাদের ধর্মপ্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়।

3 ধম্মমহামাত্র

গৌতম বুদ্ধের বাণী প্রচার, প্রজাদের কল্যাণসাধন, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন প্রভৃতি উদ্দেশ্যে অশোক ধম্মমহামাত্র নামে কর্মচারী নিয়োগ করেন।

4. ধম্মলিপি

প্রজাদের আধ্যাত্মিক মঙ্গলের উদ্দেশ্যে অশোক দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ‘ধম্মলিপি’ খোদাই করান। তিনি তাঁর নিজের ও গৌতম বুদ্ধের বাণীগুলি জনগণের কাছে প্রচারের উদ্দেশ্যে জনবহুল স্থানের নিকটবর্তী কোনো স্তূপের ওপর, পাথরের স্তম্ভে এবং পাহাড়ের গায়ে এই লিপিগুলি খোদাই করান।

5. তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি

বৌদ্ধধর্মের মতবিরোধগুলি দূর করে ধর্মের বিশুদ্ধতা, ঐক্য ও সংহতি রক্ষার উদ্দেশ্যে অশোক রাজধানী পাটলিপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধসংগীতির অধিবেশন আহ্বান করেন।

6. দূত প্রেরণ

তিনি চোল, কেরলপুত্র, সত্যপুত্র, পাণ্ড্য, সিংহল, ব্রহ্মদেশ, মিশর, গ্রিস প্রভৃতি স্থানে ধর্মদূত পাঠান। সিংহলে অশোকের পুত্র (মতান্তরে ভ্রাতা) মহেন্দ্র এবং কন্যা (মতান্তরে ভগিনী) সংঘমিত্রা, কাশ্মীরে মধ্যন্তিক, গ্রিসে মহারক্ষিত, সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে ধর্মরক্ষিত, মহারাষ্ট্রে মহাধর্মরক্ষিত, মহীশূরে মহাদেব প্রমুখ বৌদ্ধধর্ম প্রচারে যান। ইতিহাসবিদ এইচ. জি. ওয়েলস বলেছেন যে, উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকার একটি ক্ষুদ্র অঞ্চলে আবদ্ধ বৌদ্ধধর্ম অশোকের উদ্যোগে বিশ্বধর্মে পরিণত হয়। ইতিহাসবিদ সেনার্ট বলেছেন যে, অশোকের ধর্মপ্রচার এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের মনে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছিল। অহিংস ও শান্তিবাদী ধর্মপ্রচারের জন্য ড. ভিনসেন্ট স্মিথ অশোককে ‘মানবজাতির প্রথম ধর্মগুরু’ বলে অভিহিত করেছেন।

2. জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি

ধর্মপ্রচারের অঙ্গ হিসেবে অশোক বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিও গ্রহণ করেন।

1. কল্যাণ ভাবনা

তিনি তাঁর প্রজাদের নিজের সন্তান বলে মনে করতেন। তিনি বলতেন, “সবে মুনিসে পজা মমা”অর্থাৎ সকল মানুষ আমার সন্তান। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল প্রজাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণসাধন করা।

2. জনকল্যাণ প্রজাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য অশোক বিভিন্ন রাজপথ তৈরি করান, রাস্তার দু-পাশে বৃক্ষরোপণ করে ছায়াদানের ব্যবস্থা করান, বিশ্রামাগার স্থাপন করান, পানীয় জলের কূপ খনন করান ইত্যাদি।

3. চিকিৎসা সহায়তা

তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ওষধি বৃক্ষ রোপণ করান এবং মানুষের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করান।

4. বহির্দেশে জনকল্যাণ

দেশের বাইরেও অশোক তাঁর জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির প্রসার ঘটান।