আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে বিজ্ঞানের নানা শাখায় গবেষণা শুরু হয়। রজার বেকন, কেপলার, গ্যালিলিয়ো, হুক, গিলবার্ট প্রমুখ বিজ্ঞানী আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি প্রস্তুত করেন। পরবর্তীকালে নিউটন, ল্যাভয়েসিয়ার, চালর্স বয়েল, উইলিয়াম হার্ভে, হারগ্রিভস, ডেভি, জেমস ওয়াট প্রমুখ এই ভিত্তিকে আরও শক্ত করেন। এই সময় থেকে ব্যাবহারিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা শাখায় উন্নতি ঘটতে থাকে। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপে প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি ব্যবস্থায় প্রভূত অগ্রগতি ঘটে। একে কারিগরি বিপ্লব’ বা “Technological Revolution’ বলা হয়। কৃষি, সামরিক শিল্প, উৎপাদন শিল্প, জাহাজনির্মাণ শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রেই প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের অগ্রগতি ঘটে।
কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি
1.উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার
পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক নাগাদ ইউরোপে কৃষিব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটে যায়। এই সময় কৃষিপণ্যের চাহিদা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। চাহিদা অনুসারে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষিক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি ও যান্ত্রিক কলাকৌশলের ব্যবহার শুরু হয়। পূর্বে লাঙল, বলদ বা ঘোড়া এবং ফসল কাটার যন্ত্র—এই ছিল কৃষি যন্ত্রপাতি। কিন্তু কৃষি বিপ্লবের সময় থেকে কৃষি যন্ত্রপাতির প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটে। কৃষিকাজে জমিতে লাঙল দেওয়া, বীজ বপন করা, ফসল কাটা, ফসল মাড়াই করা প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রেই উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। এ যুগে কৃষি প্রযুক্তির উন্নতির প্রধান কয়েকটি দিক ছিল—লোহা দিয়ে মজবুত কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাণ, যেমন—ভারী লাঙল তৈরি, বনভূমি কেটে কৃষিজমি উদ্ধারের জন্য ভারী কুঠার তৈরি, জমির ধরন অনুসারে বিভিন্ন জমিতে পৃথক শস্যচাষের চিন্তাভাবনার প্রসার ইত্যাদি।
2. ঘোড়ার ব্যবহার
কৃষি যন্ত্রপাতিগুলি পুরোনো কৌশলে নির্মিত হলেও এই যন্ত্রপাতিগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তির কৌশল চালু হয়। বীজ বপনের ক্ষেত্রে ড্রিল লাঙলের ব্যবহার শুরু হয়। বলদ বা ষাঁড়ের পরিবর্তে কৃষিকাজে ঘোড়ার শক্তিকে কাজে লাগানো হয়। জমিতে ঘোড়ায় টানা ‘হ্যারো’ নামে লোহার ফ্রেমে কাঁটা লাগানো এক ধরনের মই-এর ব্যবহার শুরু হয়। কৃষি ও পরিবহণের কাজে অশ্বশক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে ঘোড়ার খুরে লোহার ব্যবহার শুরু হয়।
3. আবাদি জমি ও জলসেচের প্রসার
এই সময় থেকে কৃষির পদ্ধতিগত দিকেরও অগ্রগতি ঘটতে থাকে। ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও যুদ্ধবিগ্রহের আধিক্য না থাকায় মানুষের মৃত্যুর হার কমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে বাড়তি কৃষিজমির প্রয়োজন দেখা দেয়।
1. কৃষিজমির প্রসার :- বাড়তি কৃষিজমির প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশে কৃষিজমির প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিজমি উদ্ধার করা হয়। সমুদ্রের উপকূলবর্তী দেশগুলি উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমুদ্রের উপকূলে বাঁধ দিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার শুরু করে। ১৫৬৫ থেকে ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমুদ্রের উপকূল অঞ্চল থেকে প্রায় ৪৪,০০০ হেক্টর জমি উদ্ধার করে তাতে কষির প্রসার ঘটানো হয়।
2. জলসেচ :- জমিতে জলসেচ করার পাম্পিং প্রযুক্তির উন্নতি ঘটে। ইউরোপের নিম্নাঞ্চল তথা উত্তর সাগরের নিকটবর্তী বিভিন্ন দেশে অসংখ্য খাল ও নালা তৈরি করে জমিতে জলসেচের ব্যবস্থা করা হয়।
4. উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন :- জমির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বারবার একই ফসল চাষ না করে পর্যায়ক্রমিক বা রোটেশন (Rotation) প্রথায় বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শষ্যের চাষ প্রচলিত হয়। নিবিড় প্রথায় চাষের ফলে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। আবার জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য কিছুদিন জমি অনাবাদি রেখে তাতে পশুচারণ করার ব্যবস্থা হয়। জমিতে সার প্রয়োগেরও কৌশলগত উন্নতি ঘটে।
ফলাফল
1. উৎপাদন বৃদ্ধি: কৃষি প্রযুক্তি ও কৃষি পদ্ধতির অগ্রগতির ফলে ইউরোপে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। 2. পণ্যমূল্য বৃদ্ধি : এই সময় কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষকেরও সুবিধা হয়। 3. উদবৃত্ত উৎপাদন : অধিক উৎপাদনের আশায় কৃষকরা উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী হয়। উদবৃত্ত শস্য বিক্রি করে কৃষকের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসে। 4. বাণিজ্যের প্রসার : নিজেদের প্রয়োজনীয় ফসল চাষের পাশাপাশি কৃষিজমিতে বাণিজ্য-ফসল উৎপাদন শুরু হয়। এর ফলে বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। 5. শিল্পবিপ্লবে সহায়তা: শিল্পের কৃষিভিত্তিক কাঁচামাল, বিশেষ করে তুলো উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউরোপে বস্ত্রশিল্পের প্রসার ঘটে এবং তা শিল্পবিপ্লবের প্রসার ঘটাতে সহায়তা করে। 6. কৃষক শোষণ : অবশ্য কৃষি, ক্রমে লাভের মুখ দেখতে শুরু করলে এতে ধনী অভিজাত ও ভূস্বামীদের নজর পড়ে। ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের উপর বিভিন্ন পথে শোষণ শুরু হয়।