প্রাচীন ঋগ্বৈদিক যুগ থেকেই নারীসমাজে বিভিন্ন ধরনের বিবাহরীতির দিকটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। (1) বিবাহিত নারী কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণ করা, স্বামীর সঙ্গে ধর্মচর্চায় অংশ নেওয়া বা সংস্কৃতিচর্চায় রত থাকলেও ভারতীয় সমাজে বিবাহিত নারীর প্রধান কর্তব্য ছিল সুন্দর ও সুশৃঙ্খল গার্হস্থ্য জীবন পরিচালনা করা। (2) ঋগ্বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তী বিভিন্ন যুগের সমাজে নারীর বিবাহরীতি, বৈবাহিক জীবন ও গার্হস্থ্য জীবনে নানা বিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। (3) প্রাচীন ধর্মশাস্ত্র ও অন্যান্য সাহিত্যগুলিতে নারীর বিবাহরীতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। বিভিন্ন যুগে নারীর সামাজিক মর্যাদা যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তার প্রভাব নারীর বিবাহরীতিতেও পড়তে দেখা গেছে। (4) সামাজিক মর্যাদা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বিবাহরীতিতেও নারীর গুরুত্ব ক্রমে হ্রাস পেয়েছে।
ঋগ্বৈদিক যুগে নারীর বিবাহরীতি
ঋগ্বৈদিক যুগে নারীর যথেষ্ট মর্যাদা ছিল। এ যুগে নারীর বাল্যবিবাহ বা বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল না। এই সময় নারী নিজের পছন্দমতো পতি নির্বাচনের সুযোগও পেতেন। কোনো কোনো নারী আজীবন অবিবাহিত থেকে বিদ্যাচর্চা ও শাস্ত্রচর্চা করে জীবন কাটিয়ে দিতেন। এ যুগে প্রাক্-বিবাহ প্রেম ও অবৈধ প্রেমের প্রচলনও ছিল। প্রচলিত পণপ্রথা অনুসারে কন্যার পিতা পণ পাওয়ার অধিকারী ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিধবার পুনর্বিবাহ হত। সাধারণত বিধবা নারী তাঁর দেবরকে বিবাহ করতেন।
পরবর্তী বৈদিক যুগে
পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর বিবাহরীতি পূর্বাপেক্ষা কঠোর হয়। নারীর সামাজিক মর্যাদা হ্রাসের প্রভাব তার বিবাহরীতিতেও প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। এ যুগে নারীর বাল্যবিবাহ, বিধবাবিবাহ, পুরুষের বহুবিবাহ প্রভৃতির প্রচলন নারীসমাজের সামাজিক মর্যাদা হ্রাসের প্রমাণ দেয়। এই সময় উচ্চ সম্প্রদায়, বিশেষ করে রাজপরিবার বা শাসক পরিবারে বহুবিবাহের প্রচলন ছিল। এ যুগে স্বগোত্রে বিবাহের প্রচলন ছিল না। তবে সম্পূর্ণ এবং অসম্পূর্ণ অর্থাৎ উচ্চবর্ণের সঙ্গে নিম্নবর্ণের বিবাহ প্রচলিত ছিল। অবশ্য একজন আর্য পুরুষ শূদ্র মহিলাকে বিবাহ করার অধিকারী হলেও কোনো আর্য নারীকে বিবাহ করার অধিকার একজন শূদ্র পুরুষের কখনোই ছিল না। অসবর্ণ বিবাহজাত সন্তান সাধারণত পিতার বর্ণ-পরিচয়ে পরিচিত হত।
মৌর্য যুগে নারীর বিবাহরীতি
মৌর্য যুগে চারপ্রকার শাস্ত্রীয় অর্থাৎ বৈধ এবং চার প্রকার অশাস্ত্রীয় বিবাহরীতির প্রচলন ছিল। এ যুগে সতীদাহ প্রথা ও কন্যাপণের প্রচলন ছিল। নিজ জাতি ও নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহের প্রথা প্রচলিত ছিল বলে মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেছেন। স্বামী সন্ন্যাস নিলে বা নিরুদ্দেশ হলে নারী পুনরায় বিবাহ করতে পারত বলে পরাশর সংহিতায় উল্লেখ করা হয়েছে। দাম্পত্য জীবনে উপযুক্ত কারণ থাকলে নারীরা তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করতেও পারত। এ যুগে বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল বলে কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন। অর্থশাস্ত্রে এ যুগের আট প্রকার বিবাহরীতির উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি হল-
(1) ব্রাহ্ম: কোনো চরিত্রবান পাত্রকে আমন্ত্রণ করে তার হাতে পিতা কর্তৃক কন্যা-সম্প্রদান করার ঘটনাকে ব্রাহ্মবিবাহ বলা হত।
(2) দৈব: পিতা যজ্ঞের মাধ্যমে পুরোহিতের হাতে কন্যা সম্প্রদান করলে তাকে দৈব বিবাহ বলা হত।
(3) আর্য : পাত্রের কাছ থেকে এক জোড়া গাভি বা ষাঁড় নিয়ে পিতা কর্তৃক পাত্রকে কন্যা সম্প্রদান আর্য বিবাহ নামে পরিচিত।
(4) প্রাজাপত্য : পিতা স্বেচ্ছায় তাঁর নির্বাচিত পাত্রের হাতে কন্যা সম্প্রদান করলে তাকে প্রাজাপত্য বিবাহ বলে।
(5) অসুর : কন্যাপক্ষকে অর্থ দিয়ে বিবাহ সম্পন্ন করাকে অসুর বিবাহ বলে।
(6) গান্ধর্ব : অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে পাত্রপাত্রী স্বেচ্ছায় বিবাহ করলে তাকে গান্ধর্ব বিবাহ বলা হত।
(7) রাক্ষস : পাত্র জোর করে পাত্রীকে হরণ করে বিবাহ করলে তাকে রাক্ষস বিবাহ বলা হত।
(8) পৈশাচ : নিদ্রামগ্ন বা অচৈতন্য পাত্রীকে হরণ করে বিবাহ করার ঘটনা পৈশাচ বিবাহ নামে। পরিচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রথম পাঁচটি বিবাহরীতির ক্ষেত্রে সামাজিক অনুমোদন থাকলেও পরের তিনটির ক্ষেত্রে তা ছিল না।
মৌর্য-পরবর্তী যুগে নারীর বিবাহরীতি
মৌর্য-পরবর্তী যুগে বিবাহের ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদার যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছিল। (1) এ যুগের শাস্ত্রকার মনু বলেছেন যে, বিবাহিতা নারী তার স্বামীর উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল হতে বাধ্য। তিনি মনে করতেন যে, “স্বামীর উচিত স্ত্রীকে সর্বদা সঙ্গদান করে রক্ষা করা, না হলে স্ত্রী পরপুরুষের সঙ্গে ব্যভিচারিণী হতে পারে।” মনু আরও বলেছেন যে, নারী প্রথম জীবনে পিতার অধীনে, বিবাহিত জীবনে স্বামীর অধীনে এবং পরবর্তী জীবনে পুত্রের অধীনে বার্ধক্য জীবন কাটাবেন। (2) এ যুগে ‘অনুলোম’ ও ‘প্রতিলোম’ বিবাহরীতি প্রচলিত ছিল। উচ্চবর্ণের পুরুষ ও নিম্নবর্ণের নারীর মধ্যে সংঘটিত বিবাহ হল ‘অনুলোম’ বিবাহ। ‘প্রতিলোম’ হল নিম্নবর্ণের পুরুষ ও উচ্চবর্ণের নারীর মধ্যে সংঘটিত বিবাহ।
গুপ্ত যুগে নারীর বিবাহরীতি
গুপ্ত যুগে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিবাহকার্য সম্পন্ন হত। (1) এ যুগে সাধারণত চার প্রকার বিবাহরীতির বহুল প্রচলন ছিল ব্রাত্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য বিবাহ। তবে রাজপরিবারে পাত্রপাত্রীর নিজের পছন্দে অর্থাৎ গান্ধর্ব বিবাহের প্রমাণ পাওয়া যায়। রাজকন্যার বিবাহের জন্য পিতা স্বয়ংবর সভার আয়োজন করতেন লও জানা যায়। (2) এ যুগে অপ্রাপ্ত বয়স্ক এবং প্রাপ্ত বয়স্ক উভয় প্রকার নারীর বিবাহের প্রথাই প্রচলিত ছিল। যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতে অল্পবয়স্ক মেয়েদের বিবাহের উল্লেখ আছে। ও এ যুগের বিবাহে অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহরীতি এবং পুরুষের একাধিক পত্নী গ্রহণের প্রথা প্রচলিত ছিল। এ যুগের ব্রাহ্মণ বাকাটক রাজবংশের সঙ্গে অন্য বর্ণের বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। (4) তবে স্বগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল বলে হিউয়েন সাঙ উল্লেখ করেছেন।
গুপ্ত-পরবর্তী যুগে
(1) গুপ্ত-পরবর্তী যুগে সাধারণত মেয়েদের বয়স ১২ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিবাহ দেওয়া হত। নারীর বিবাহের বয়স প্রসঙ্গে হরিভদ্র তাঁর ধর্মবিন্দু গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, বিবাহের সময় ছেলেদের বয়স ২৬ এবং মেয়েদের বয়স ১২ বছর হওয়া উচিত। (2) এ যুগে রাষ্ট্রকূট রাজবংশের নারীরা স্বয়ংবর সভার মাধ্যমে পতি নির্বাচনের স্বাধীনতা পেত। (3) গুর্জর প্রতিহার সমাজে সাধারণত সবর্ণে নারীদের বিবাহ হত। তবে সগোত্রে বিবাহ প্রচলিত ছিল না। (4) পরবর্তীকালে পাল ও সেন যুগে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সবর্ণ বিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ প্রভৃতির প্রচলন ছিল। সেন যুগে নারীর বাল্যবিবাহের বহুল প্রচলন ছিল। (5) বিবাহে যৌতুকপ্রথা ও কৌলীন্যপ্রথার প্রকোপ বেড়েছিল। কৌলীন্যপ্রথার ফলে পুরুষের বহুবিবাহের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। (6) সুলতানি আমলে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সমাজের মেয়েদেরই কম বয়সে বিয়ে দেওয়া হত। বহু ক্ষেত্রে তুর্কি মুসলিম অভিজাতরা হিন্দু নারীকে বিবাহ করত।