‘দলিত’ শব্দটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো। ভারতে দলিত আন্দোলনের বিকাশ কীভাবে ঘটে?

(উত্তর) প্রথম অংশ : দলিত’ শব্দের তাৎপর্য : আক্ষরিক অর্থে ‘দলিত’ বলতে বোঝায় সেইসব মানুষকে যারা অস্পৃশ্য, নিপীড়িত, মর্দিত, পিষ্ট ও দমিত। ১৯৩০-এর দশক থেকে অস্পৃশ্যরা নিজেদেরকে ‘দলিত’ বা নিপীড়িত পরিচয় দিতে শুরু করে। হিন্দু প্রধান ভারতবর্ষে এদের আর্থসামাজিক অবস্থানকে বোঝানোর জন্য ‘দলিত’ শব্দটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ও উপযুক্ত ছিল।

ভারতে বর্ণব্যবস্থাযুক্ত সমাজব্যবস্থায় উচ্চবর্ণের দ্বারা শোষিত ও অত্যাচারিত নিম্নবর্ণের হিন্দু বা অস্পৃশ্যরা (যারা ‘পঞ্চম জাতি’ নামেও পরিচিত) ঔপনিবেশিক শাসনকালে দলিত নামে পরিচিতি লাভ করে। এরা—

প্রথমত, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার থেকে এরা বঞ্চিত ছিল অর্থাৎ, মন্দিরে প্রবেশ, পুকুর বা জলাধার ব্যবহার, বিদ্যালয়ে লেখাপড়া, সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে বঞ্চিত ছিল।

দ্বিতীয়ত, দলিতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মধ্যভারতের মাহার সম্প্রদায়, দক্ষিণ ভারতের ইজাভা ও পুলায়া সম্প্রদায় এবং বাংলার নমঃশূদ্রগণ।

ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী দলিতদের পশ্চাৎপদ শ্রেণি বা পিছড়ে বর্গ বলে আখ্যা দেয়। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ‘তপশিলি জাতি’। অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধির কাছে দলিতরা ছিল ‘হরিজন’ বা ‘ঈশ্বরের সন্তান’।

WhatsApp ChannelJoin Now
Telegram Channel Join Now

❑ দ্বিতীয় অংশ, দলিত আন্দোলনের বিকাশে নারায়ণ গুরু, জ্যোতিবা ফুলে, বি আর আম্বেদকরের মতো নেতা এবং ঔপনিবেশিক শাসননীতি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।

1. জ্যোতিরাও ফুলে

উনিশ শতকের শেষদিকে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে জ্যোতিবা ফুলের নেতৃত্বে ধারাবাহিকভাবে বর্ণপ্রথা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তাঁর সহধর্মিণী তাঁর সংস্কার আন্দোলনের একান্ত সহযোগী ছিলেন। বস্তুত, জ্যোতিরাও ফুলে ছিলেন আধুনিক ভারতের প্রথম ব্যক্তি যিনি সমাজের তথাকথিত নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের অর্থাৎ দলিতদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস জুগিয়েছিলেন। জনসাধারণের কাছে তিনি ছিলেন ‘মহাত্মা’!

2. নারায়ণ গুরু

দক্ষিণ ভারতে দলিতদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান শ্রী নারায়ণ গুরু। শ্রীনারায়ণ ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে একাধারে জাতীয় আন্দোলন ও সামাজিক আন্দোলনকে একসূত্রে বাঁধতে চেয়েছিলেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় আন্দোলন শুরু হয় মন্দিরে প্রবেশ সংক্রান্ত।

3. আত্মমর্যাদা আন্দোলন

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস নেতা ই ভি রামস্বামী নাইকার হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং দলিত শ্রেণির জন্য সামাজিক সমতা ও সম-অধিকার দাবি করেন। তিনি মূলত তামিলনাড়ুতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনের নাম দেন ‘আত্ম-মর্যাদা আন্দোলন’ বা ‘সেলফ রেসপেক্ট আন্দোলন’। এই আন্দোলন ক্রমশ উগ্ররূপ ধারণ করে।

4 বি আর আম্বেদকর

বিশ শতকের ‘দলিত’ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেন মহারাষ্ট্রের ‘মাহার’ শ্রেণিভুক্ত ড. বি আর আম্বেদকর। তিনি ব্যক্তিগতভাবে লড়াই চালিয়ে ‘দলিত’দের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান পালটে দেন। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সংবিধানে তার প্রতিফলন ঘটে।

5. দলিতদের রাজনৈতিক অধিকার

উপরোক্ত বিভিন্ন কারণে দলিতরা সংঘবদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে এবং বিশ শতকের প্রথমে নিজেদের জন্য আর্থসামাজিক অধিকারসহ রাজনৈতিক অধিকার দাবি করে। প্রথমে মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার (১৯১৯ খ্রি.) এবং পরে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ও পুনা চুক্তির (১৯৩২ খ্রি.) মাধ্যমে দলিত সম্প্রদায় রাজনৈতিক অধিকার লাভ করে।

উপসংহার

ঐতিহাসিক শেখর বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, ভারতবর্ষে অন্য যেসব সামাজিক গোষ্ঠী কংগ্রেসি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে নিজেদেরকে দূরে রেখেছিল, তারা হল অব্রাক্ষ্মণ ও অস্পৃশ্যরা।