শস্যবীজ সংরক্ষণ
পশ্চিমবঙ্গের বহু অঞ্চলে আর্দ্র ও উষ্ণ আবহাওয়ার জন্য বীজ সংরক্ষণ করা খুবই অসুবিধাজনক। ফলে চাষী ভাইয়েরা নিজেদের বীজ নিজেরাই সংরক্ষণ করতে পারেন না এবং বাইরে থেকে বেশী দামে এবং বহু ক্ষেত্রে নিম্নমানের বীজ কিনতে বাধ্য হন। বেশির ভাগ শস্যবীজ ভাল করে শুকিয়ে নিয়ে সংরক্ষণ করতে হয় এবং যত ভালভাবে শুকনো করা যাবে। ততই সংরক্ষণের পক্ষে সুবিধাজনক। সংরক্ষণের জায়গায় তাপমাত্রা কম থাকলে বীজের জীবনীশক্তি বেশীদিন অক্ষুণ্ণ থাকে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং আর্দ্রতাশূন্য গুদামে উপযুক্তভাবে শুকনো করা বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বহুদিন অক্ষুণ্ণ থাকবে। কিন্তু এই ব্যবস্থা করা বেশ ব্যয় সাপেক্ষ এবং কৃষকদের প্রায় নাগালের বাইরে, তাই প্রখর সূর্যতাপে ভাল করে শুকিয়ে নিয়ে যদি বায়ু নিরোধক পাত্রে (যেমন ধাতুর পাত্র, মোটা পলিথিনের পাত্র বা ব্যাগ ইত্যাদি) রাখা যায় তবে সমস্যার অনেকটা সুরাহা হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে অনেক সময় বীজ ভালভাবে শুকনো করা যায় না এবং সংরক্ষণের জন্য মাটির পাত্র বা চটের বস্তাই ব্যবহার করতে হয়। এর ফলে বিশেষ করে বর্ষার সময় বীজের মধ্যে শতকরা জলীয় ভাগের পরিমান আরও বেড়ে যায় এবং জীবনীশক্তি ও অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা কমতে আরম্ভ করে।
বীজের সংরক্ষণ ক্ষমতা ও সংরক্ষিত বীজের উৎকর্ষতা বাড়াবার জন্য এখানে কতকগুলি সহজ ও সরল বীজ শোধন পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো
(১) প্রাক সংরক্ষণ বীজ শোধন পদ্ধতি (Pre storage seed treatment):
ফসল তোলার সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়াই মাড়াই এর পর যে পরিমাণ বীজ সংরক্ষণ করা হবে তা রোদে খুব ভাল করে শুকিয়ে নিতে হবে। এবার একটি বায়ু নিরোধক পাত্রে প্রতি কেজি বীজের জন্য দু গ্রাম হারে তাজা ব্লিচিং পাউডার (bleaching powder) খুব ভালভাবে নাড়াচাড়া করে তক্ষুনি ঢাকনা বন্ধ করে দু’তিন দিন রেখে দিতে হবে। পরে বীজ অন্য পাত্রে বা চটের ব্যাগে সরিয়ে রাখা যেতে পারে।
এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে ব্লিচিং পাউডার থেকে যে ক্লোরিন গ্যাস বেরিয়ে আসে সেটাই সংরক্ষণের জন্য একান্ত প্রয়োজন, তাই যে পাত্রটা ব্যবহার করা হবে তার মুখ যেন নিশ্ছিদ্রভাবে বন্ধ করা যায়। আর ভাল ঢাকনিযুক্ত পাত্র যদি না পাওয়া যায় তাহলে খুব ঘন বুনুনীর চটের ব্যাগও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে ব্লিচিং পাউডারের পরিমাণ প্রতি কেজি বীজের জন্য ২ গ্রাম থেকে বাড়িয়ে ৩-৪ গ্রাম করতে হবে।
(২) সংরক্ষণকালীন শোধন পদ্ধতি (Mid storage treatment) :
এই সংরক্ষণ পদ্ধতি মাঝারি এবং নিম্ন জীবনীশক্তি সম্পন্ন বীজ (medium and low vigour seed) এবং ডাল বা শুঁটি জাতীয় নয় এমন বীজের পক্ষে খুবই উপযুক্ত। বীজের জাতের উপর নির্ভর করে ৩-৬ মাস (অথবা বোনার পর বাড়তি বীজ) সংরক্ষণের পর যখন বীজের জীবনীশক্তি কমে আসে কিন্তু অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা মোটামুটি বজায় থাকে তখন প্রথমে জলে আধঘন্টা মত ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরে জল থেকে ছেঁকে তুলে নিয়ে দুই তিন ঘন্টা ভিজে চট বা মোটা কাপড় ঢাকা দিয়ে অথবা মুখ ঢাকা গামলা জাতীয় পাত্রে রাখতে হবে। তারপর খুব পাতলা আস্তরণে বিছিয়ে দিয়ে কড়া রোদে পর পর দু-তিন দিন শুকাতে হবে। শুকানোটা এমন হবে যে জলে ভেজানোর আগে যদি বীজের ওজন ১০ কেজি হয় তবে ভিজিয়ে শুকনো করার পরও যেন অতি অবশ্যই ১০ কেজি বা তার থেকে কম হয়। নিম্ন জীবনীশক্তি সম্পন্ন বীজ (low vigour seed) ১-৪ ঘন্টা জলে ভিজিয়ে উপরোক্ত পদ্ধতিতে শুকিয়ে নিলে পরবর্তী সংরক্ষণের সময় অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ভাল থাকবে। যদি সম্ভব হয় তবে সংরক্ষণকালীন শোধণ পদ্ধতিতে জলের বদলে পটাসিয়াম বা সোডিয়াম হাইড্রোজেন ফসফেট বা সোডিয়াম ক্লোরাইডের (খাবার লবন) অতি লঘু দ্রবণ (প্রতি লিটার জলে ৫০-১০০ মিলিগ্রাম) ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে অনেক শস্য বীজে বেশী সুফল পাওয়া যায়।
চীনা বাদাম, শুটি জাতীয় ফসল হলেও এর ক্ষেত্রে উপরোক্ত সংরক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। ৪-৫ মাস ধরে বস্তাজাত খোসা সমেত চীনাবাদাম জলে ৫-৬ ঘন্টা ভিজিয়ে উপরোক্ত পদ্ধতিতে খুব ভাল করে শুকিয়ে নিয়ে পরবর্তী বোনার কাল পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এর ফলে অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ও জীবনীশক্তি বেশী অশোধিত বীজের থেকে ভাল থাকবে।
(৩) প্রাকৃপন বীজ শোধন পদ্ধতি (Pre sowing treatment) :
এই পদ্ধতিতে মাঠে বীজ বোনার আগে য়েকটি রাসায়নিক দ্রবণে ডুবিয়ে নিতে হবে। পটাসিয়াম বা সোডিয়াম হাইড্রোজেন ফসফেট ঘটিত লবন (Potassium or sodium hydrogen phosphate) প্রতি লিটার জলের জন্য ১০০ মিগ্রা হারে গুলে নিয়ে প্রতি কেজি বীজের জন্য ২ লিটার মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে। বীজ ৩-৪ ঘন্টা ভিজিয়ে নিয়ে তারপর তুলে হাল্কাভাবে শুকিয়ে সরাসরি বুনতে হবে।
[…] […]